প্রধান দলগুলোর কাছাকাছি পৌঁছার চেষ্টা

ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন

শীর্ষ নেতা-নেত্রীর অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের সম্ভাবনা। নেতাদের সাথে আবার বসতে পারেন প্রধান উপদেষ্টা

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এক বছর পূর্তি ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকারের গতি, রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত অবস্থান এবং জনগণের প্রত্যাশা- সবমিলিয়ে এখন একটি ‘সমঝোতাভিত্তিক নির্বাচন’ নিয়েই আলোচনা তীব্র হচ্ছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
Printed Edition

খালিদ সাইফুল্লাহ/ ইকবাল মজুমদার তৌহিদ/ হারুন ইসলাম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারো এক নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা ও ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দৃশ্যত এখনো পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেখা গেলেও শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সমঝোতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এক বছর পূর্তি ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকারের গতি, রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত অবস্থান এবং জনগণের প্রত্যাশা- সবমিলিয়ে এখন একটি ‘সমঝোতাভিত্তিক নির্বাচন’ নিয়েই আলোচনা তীব্র হচ্ছে।

জুলাই সনদ ও নির্বাচন রূপরেখা

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ঘোষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। সনদের মূল লক্ষ্য ছিল- গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন, নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং দলীয় রাজনীতির পুনর্নির্মাণ।

এ সনদের অধীনে গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশন সংস্কার, রাজনৈতিক অর্থায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন সরকারের লক্ষ্য- ফেব্রুয়ারির মধ্যেই এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা, যা এই সংস্কারকাঠামোর ‘প্রথম পরীক্ষামূলক প্রয়োগ’ হিসেবে দেখা হবে।

সংলাপের অগ্রগতি : সন্দেহের পরও শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংলাপ টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ঘোষণা নিয়ে সুপারিশ জমা দেয়ার আগে জাতীয় ঐকমত্য পরিষদ দুই সপ্তাহে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, জাতীয় গণ অধিকার পরিষদ ও কয়েকটি বামধারার জোটের সাথে বৈঠক করে। সংলাপে অংশ নেয়া এক সিনিয়র নেতা জানান- ‘সংলাপে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে নির্বাচন ছাড়া স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। কিন্তু কবে, কিভাবে এবং কোন প্রশাসনিককাঠামোর অধীনে- সেটিই এখন মূল বিতর্ক।’

বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে; তাদের মতে, অন্তর্বর্তী প্রশাসন দীর্ঘ হলে অনিশ্চয়তা বাড়বে। অন্য দিকে জামায়াত ও এনসিপি চায়, সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশ বাস্তবায়ন নিশ্চিত হওয়ার পরেই ভোট হোক- যাতে ‘পুরনো প্রভাবমুক্ত নির্বাচন’ নিশ্চিত হয়। বাম ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মগুলো বলছে, নির্বাচন হবে কেবল তখনই অর্থবহ, যখন রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করবে।

জুলাই সনদে সই করা অংশের দায় নেবে না বিএনপি

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদে আমরা যে অংশে সই করেছি, তার দায়দায়িত্ব আমরা নেবো। কিন্তু যেটা আমরা সই করিনি, সেটার দায় আমরা নেবো না।’ গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, ‘সনদে সই করার সময় আমরা পরিষ্কার করেছিলাম- যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হবে, সেগুলো সই হবে; যেসব বিষয়ে একমত হবে না, সেগুলো নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখই নেই। আমাদের বক্তব্যগুলো বেমালুম বাদ দেয়া হয়েছে; বরং নতুন কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে- এটা জনগণের সাথে নিঃসন্দেহে প্রতারণামূলক কাজ।’

তবে মির্জা ফখরুল একই সাথে বলেন, ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে। পিআর হবে কি না, ওটা আগামী পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেবে। গণভোটের প্রসঙ্গে আমরা রাজি হয়েছি। আলাদা করে গণভোটের প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আমরা বলেছি নির্বাচনের দিনই গণভোট করা হোক, এতে খরচ কমবে। কারণ আলাদা গণভোটে প্রায় হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। তাই নির্বাচনের ব্যালটে দু’টি বিষয় থাকবে- একটি সংসদ নির্বাচন, অন্যটি গণভোট। এটা ছিল একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত। এটা না করে এখন আবার তারা বলছে গণভোট আগে হতে হবে। তারপরে নির্বাচন হবে।

চলমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আমি এবং আমার দল বিশ্বাস করে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই নির্বাচন হবে। জনগণকে দেয়া কথা সরকার রাখবেন। তবে একটি শ্রেণী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতেই নির্বাচন দিতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরো বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে পুরনো ধাঁচের অর্থনীতি পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক অর্থনীতি নিশ্চিত করা হবে। যেন প্রত্যেক মানুষ সমানভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেন।

এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশের ৯০ ভাগ মানুষ এখন নির্বাচন চান। কিন্তু কিছু গোষ্ঠী জনগণের এই চাওয়ার বিরুদ্ধে কাজ করছে। তারা নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। আমার বিশ্বাস দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের এই অপচেষ্টা রুখে দেবে এবং ঘোষিত ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। প্রশ্ন হলো- বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে- জুলাই সনদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপ ব্যবস্থা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলমান। দলের শীর্ষ নেতাদের এই অবস্থান সংলাপ প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন; বিশেষ করে সনদে থাকা নোট অব ডিসেন্ট ও তার প্রকাশ্যতা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও অসন্তোষের বিষয়গুলো এখন ক্রান্তিকালীন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

পিআর নিয়ে নমনীয়, গণভোট আগে চায় জামায়াত

জামায়াতে ইসলামী নিম্নকক্ষে পিআর নিয়ে ছাড় দিলেও গণভোট আগে করার বিষয়ে অনমনীয়। গণভোটের বিষয়ে অবস্থান প্রসঙ্গে জামায়াত আমির যুক্তরাজ্যে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গণভোটের বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট, গণভোট আগে হতে হবে। অন্যথায় এটা মূল্যহীন। পরে হলে এর দুই পয়সার মূল্য নেই।’

দলের নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের আগে গণভোটের বিষয়ে জোর দিয়ে নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেছেন- গণভোটে বাস্তবায়নের পক্ষে রায় না হলে কিসের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা হবে। গণভোটের বিষয়ে ছাড় দেয়ার অর্থ হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ছাড় দেয়া। জুলাই বিপ্লব সেক্ষেত্রে অর্থহীন হয়ে পড়বে।

জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি নতুন করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে এটি একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। জনগণ ফেব্রুয়ারিতে যে একটি জাতীয় নির্বাচন চাইছে, নির্বাচনের ঠিক আগে হঠাৎ এ রকম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-উত্তাপ তৈরি করা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে আমরা মনে করি।

ডা: তাহের আরো বলেন, এ রকম অশুভ চক্রের কাছে প্রধান উপদেষ্টা নতিস্বীকার করবেন, বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং ষড়যন্ত্রের কাছে নতিস্বীকার করে উনি সনদকে আইনি ভিত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাবেন, এটা আমরা আশা করি না। আমরা উনার কাছে এ আশাই করি যে সংস্কার-রিফর্ম ছিল উনারই নিজস্ব প্রোডাক্ট। উনি উনার এ সন্তানকে নিজ হাতে ছুড়ে দিয়ে হত্যা করবেন, এটা জাতি বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন, আর যদি এটাই প্রধান উপদেষ্টা করেন তাহলে জাতির সাথে যে ওয়াদা উনি করেছিলেন সে ওয়াদা উনি ভঙ্গ এবং খেলাফ করবেন বলেই জাতি মনে করবে। আমরা আশা করি, উনি দৃঢ় ভূমিকা পালন করবেন এবং সংস্কার বাস্তবায়নে যথার্থ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরিকৃত জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বেশির ভাগ দল। তবে জুলাই সনদের এখনো আইনি ভিত্তি দেয়া হয়নি। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ আটটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং এর আলোকে জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। এ জন্য তারা যুগপৎভাবে আন্দোলন করে আসছে। অন্য দিকে বিএনপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও পরে ওই সনদে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। এমনকি বিএনপি নেতারা এখন জুলাই সনদ প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করছেন।

এনসিপি জুলাই সনদের আদেশ জারি হলে গণভোটে ছাড় দিতে পারে

বিএনপি-জামায়াত প্রকাশ্যে বিরোধে জড়ালেও নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বোঝাপড়ার কথা শোনা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। গতকাল রাজধানীর পল্টনে এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটি বোঝাপড়া হচ্ছে- এমনটি আমরা শুনতে পাচ্ছি। বিএনপি নোট অব ডিসেন্টের বিষয় থেকে সরে আসবে, আর নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি থেকে জামায়াত সরে আসবে- এ ধরনের একটি অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি।

গতকাল এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়কারী মাহবুব আলম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকার আদেশ জারির মাধ্যমে নিশ্চিত করলে একই দিন গণভোট ও নির্বাচন অনুষ্ঠানে এনসিপি আপত্তি জানাবে না।

অন্য দিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের মাধ্যমে জাতির সাথে প্রতারণা করেছেন, বিএনপির এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছিলাম, জুলাই সনদে সই করার আগে সেটি দেখতে হবে। তারা ওই সনদ না দেখে কেন স্বাক্ষর করল? তাদের তো আগে দেখা উচিত ছিল। আমরা আগেই বলেছিলাম, এটি আমাদের দেখাতে হবে। কে জুলাই সনদ ঘোষণা করবেন, সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। সেটাকে অর্ডার জারি করতে হবে। আমরা তো অবিবেচকের মতো সই করি নাই।’

এনসিপির এই নেতা আরো বলেন, ‘আমরা সংস্কার পিছিয়ে দিতে চাই, এমন অভিযোগও ছিল। আমরা বারবার বলেছিলাম, জুলাই সনদ ও এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার বিষয়টি সুরাহা হতে হবে। এগুলো জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে। তার পরই স্বাক্ষর করব।’

ফেব্রুয়ারি : বাস্তবসম্মত সময়সীমা না রাজনৈতিক চাপ?

অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরের সূত্র বলছে, নির্বাচন কমিশন চাইছে ১৫ ফেব্রুয়ারির আশপাশে ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এটি কি বাস্তবসম্মত সময়সীমা, নাকি রাজনৈতিক চাপের ফল? একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন- সংস্কার কাঠামো এখনো আংশিক বাস্তবায়িত। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হলে সেটি হবে একটি ‘ট্রানজিশনাল ভোট’, পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পথে এক ধাপ এগোনো।

বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী কূটনৈতিক মিশনের একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন- আগামী নির্বাচন ঘোষিত ফেব্রুয়ারির সময়েই হবে। রাজনৈতিক ঝগড়া এক সময় থেমে যাবে। প্রয়োজনে বিএনপির শীর্ষ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হস্তক্ষেপ করবেন। জামায়াতের আমীর দেশে ফেরার পর দুই শীর্ষ নেতা-নেত্রীর সাথে কথাও হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সাথে আরেক দফা বসতে পারেন। শেষ কথা হলো নির্বাচন সময়মতো হবে। নির্বাচন হওয়ার মধ্যে জুলাই আন্দোলনের পক্ষের সব রাজনৈতিক শক্তির স্বার্থ নিহিত। আর নির্বাচন না হওয়ার অর্থ হলো পতিত স্বৈরাচারী রাজনৈতিক শক্তি আবার ফিরে আসা- সেটি কেউই শেষ পর্যন্ত চাইছে না।

এ দিকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর আগ্রহও বাড়ছে। জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে ‘সংস্কারভিত্তিক নির্বাচন তদারকি’র প্রস্তাব দিয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থার ইঙ্গিত দেয়।

রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ : কে লাভবান?

এটি ঠিক যে রাজনৈতিকভাবে এই সময়সূচি নিয়ে দলগুলোর ভেতরে চলছে তীব্র হিসাব-নিকাশ। বিএনপি চায় মধ্য ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন। জামায়াত ও এনসিপির এ সময়ে নির্বাচনে আপত্তি নেই। জামায়াতসহ আট ইসলামী দল সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চিত গ্যারান্টি চায়। এনসিপি প্রথমে সাধারণ নির্বাচনের আগেই গণভোট দাবি করলে এখন তারা অবস্থানকে নমনীয় করে একই দিন নির্বাচন হলেও আপত্তি না থাকার কথা জানাচ্ছে। ঐকমত্য কমিশন নির্দিষ্ট সুপারিশ না করে একই দিন অথবা আগে গণভোটের সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে বলে মত দিয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক জোটগুলো চাইছে একটি ‘নতুন সামাজিক চুক্তিভিত্তিক নির্বাচন’, যেখানে পুরনো দলীয় প্রভাব কমবে। নতুন বাংলাদেশের অভিযাত্রা ঘটবে। এ অবস্থায় বলা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যদি হয়, তা হবে ‘রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের এক বাস্তব পরীক্ষা’।

সরকার কী চাইছে

জুলাই সনদ ও তা বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি ও মিত্র দলগুলো এবং জামায়াত এনসিপি ও সমমনা দলোর মধ্যে বিভক্তির মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার বলছে নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম শুক্রবার জোরালোভাবে এ কথা বলার পর গতকাল ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন যে ফেব্রুয়ারির নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচন হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপদেষ্টা ব্যক্তিগত আলাপে পরিষ্কার জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা ঘোষিত সময়ে নির্বাচন দিয়ে সরকার থেকে বিদায় নিতে চান। তবে এই নির্বাচন যেন তেন নির্বাচন হবে না। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুসারে বাস্তবেই এটি হবে একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন।

সম্ভাবনা ও ঝুঁকি

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরল মুহূর্ত- যেখানে সব দল আলোচনায় প্রকাশ্যে বৈরিতায় থাকলেও অন্তরালে যোগাযোগ বজায় রেখেছে। তবে আশঙ্কাও রয়েছে, ঐকমত্যের শেষ মুহূর্তে কেউ পিছিয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। বিশেষত আওয়ামী লীগের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা এবং সে অবস্থানের প্রতি প্রতিবেশী দেশের সমর্থন পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যায় তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন অনেকে। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন- ‘জুলাই সনদ ছিল সংস্কারের প্রতীক, কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে সেটি রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় রূপ নিতে হবে। সময়সীমা যতই চাপসৃষ্টিকারী হোক, নির্বাচন এখন দেশের গণতান্ত্রিক পথচলার অপরিহার্য ধাপ। নির্দিষ্ট সময়সীমা ও সংস্কার দুটো নিশ্চিত করতে পারলেই সবচেয়ে ভালো।

সবশেষে বলা যায়, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এখন কেবল রাজনৈতিক নয়, জাতীয় পুনর্গঠনেরও প্রশ্ন। দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা যদি বজায় থাকে, তবে এটি হতে পারে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন। এই নির্বাচন নতুন বাংলাদেশ গঠনের দিকে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে।