এবার ফিলিপাইনেও বাড়ছে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ

ফিলিপাইনে টিকটক, ফেসবুক ও এক্সে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষোভ। মানুষ প্রশ্ন তুলছে, সরকার সড়ক, সেতু ও বাঁধ নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো ব্যয় করলেও কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?

নয়া দিগন্ত অনলাইন
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাজপথে গড়িয়েছে
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাজপথে গড়িয়েছে |সংগৃহীত

অস্বাভাবিক রকমের তীব্র মৌসুমি বৃষ্টিতে নজিরবিহীন বিপর্যয় নেমে এসেছে ফিলিপাইনের জনজীবনে। অভিযোগ উঠেছে, দেশটির বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। যা দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করেছে।

শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

ফিলিপাইনে প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তাগুলো যেন নদীতে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চলাচল নিয়ে সংকটে পড়েছেন। এর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে লেপ্টোসপাইরোসিস নামে লিভারের রোগ। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করা ইঁদুরের মল থেকে এ রোগ ছড়াচ্ছে।

ক্রিসা তলেন্তিনো নামে ৩৬ বছর বয়সী এক স্কুল শিক্ষিকার সাথে বিবিসির কথা হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে প্যাডেলবোটে করে জলমগ্ন রাস্তা পাড়ি দিয়ে কর্মস্থল আপালিত শহরে যান তিনি। যাতায়াতের জন্য তার আর কোনো বিকল্প নেই। আপালিতে তিনি ক্যান্সারের চিকিৎসাও নেন।

তিনি বলেন, অনেক আগেই বন্যাকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তিনি। কারণ বছরে মাত্র দুই মাসের মতো সময় সড়ক শুকনো থাকে। কিন্তু, এবার তিনি খুবই ক্ষুব্ধ।

তলেন্তিনো বলেন, ‘আমি প্রতারিত বোধ করছি। আমি কঠোর পরিশ্রম করি, অপচয় করি না। প্রতি মাসে আমার বেতন থেকে কর কেটে নেয়া হয়। তারপর শুনি, আমাদের কোটি কোটি টাকার কর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা ভোগ করছেন।’

এই অভিযোগ এখন পুরো ফিলিপাইনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক, ফেসবুক ও এক্সে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ প্রশ্ন তুলছে, সরকার সড়ক, সেতু ও বাঁধ নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো ব্যয় করলেও কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?

‘ভূতুড়ে’ প্রকল্পের জন্য চুক্তি হয়, যেগুলো বাস্তবে কখনোই আলোর মুখ দেখে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীরা এমন অভিযোগ তুলে সংসদ সদস্য ও নির্মাণ খাতের সাথে যুক্ত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাচ্ছেন।

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোস জুনিয়র নিজেও এই সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি দেখেন, সেটি আদৌ নির্মিতই হয়নি।

পরে এক বক্তব্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে বরাদ্দ সরকারি অর্থের ৭০ শতাংশই দুর্নীতির কারণে আত্মসাৎ হয়। এই ঘটনায় সংসদের স্পিকার পদত্যাগ করেন, যদিও তিনি কোনো দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

এদিকে, সিনেটের নেতাকে পদচ্যুত করা হয়েছে। কারণ ২০২২ সালে তার নির্বাচনি প্রচারণায় একটি সরকারি প্রকল্পের দরপত্রের কাজ পাওয়া ঠিকাদার অনুদান দিয়েছিলেন। যা আইনত নিষিদ্ধ।

আগামী রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) একটি দুর্নীতিবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা।

১৯৭২ সালের এই দিনেই সাবেক নেতা ফার্দিনান্দ মার্কোস দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন। তার ছেলে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোস জুনিয়রের জানার কথা, জনরোষ কতটা ভয়ংকর হতে পারে। ১৯৮৬ সালে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনই তার বাবাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। যা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো আত্মসাতের অভিযোগ ছিল মার্কোসের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখে আইন সংস্কারের পথে হেঁটেছে ইন্দোনেশিয়া। গত সপ্তাহেই একই ধরনের আন্দোলন নেপালে সরকার পতনের কারণ হয়েছে।

তাই সোমবার যখন ফিলিপাইনের নাগরিকরা জবাব চাইছিল, প্রেসিডেন্ট মার্কোস জুনিয়র ঘোষণা দেন একটি তদন্ত শুরু হবে, যা ‘প্রতারকদের মুখোশ খুলবে এবং তারা কত টাকা চুরি করেছে তা বের করবে’।

ফিলিপাইনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এখন সরকারি অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগ আছে এমন রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদারদের সন্তানদের দিকেও ক্ষোভের তীর ছুঁড়ছেন। তাদেরকে ‘নেপো বেবি’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেছে, ‘ডিজাইনার পোশাক’ পরা ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করার চিত্র যারা তুলে ধরছেন তাদের নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করা হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তাদের (নেপো বেবি) উচিত করদাতাদের ধন্যবাদ জানানো, কেননা তাদের কেনাকাটা ও ভ্রমণের খরচ সেই কর থেকেই এসেছে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি নেপালে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে একটি ‘নেপো কিড’ প্রচারণা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন হয়।

ফিলিপাইনে একজন সাবেক সংসদ সদস্যের মেয়েকে পোশাকের জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তিনি ফেন্ডি ও ডিওর মিলিয়ে পরেছিলেন এবং বহুল কাঙ্ক্ষিত ও দামি হারমেসের বারকিন ব্যাগ বহন করছিলেন। এ ধরনের তীর্যক মন্তব্যের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা অনেকেই তাদের অ্যাকাউন্টে মন্তব্যের সুযোগ বন্ধ বা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন।

অন্যদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয় কিছু অ্যাকাউন্টের পেছনের মানুষদের একত্রিত করেছে। ক্রিয়েটরস অ্যাগেইনস্ট করাপশন নামের একটি গ্রুপ বলছে, ‘আমরা থামবো না। বরং আরো সোচ্চার হবো। আমরা ক্ষমতার সামনে আয়না ধরবো এবং ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত সরে দাঁড়াবো না।’

ফিলিপাইনজুড়ে এই ক্ষোভ শুধু অনলাইনে নয়, অফলাইনেও ছড়িয়ে পড়েছে। গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের জনসমক্ষে অপমান, অপদস্ত হওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে এই বিভাগের প্রকৌশলীদের ইউনিফর্ম না পরার কথা বলা হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি