ট্রাইব্যুনালে প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন

শেখ হাসিনার কল রেকর্ড : পুলিশকে মারণাস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ

৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র আনাসসহ ৬ জনকে গুলি করে হত্যা

“এখন ফরমাল চার্জ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হবে। আগামী অল্প কিছুদিনের মধ্যে এটা আমরা আদালতে দাখিল করব।”

হাবিবুর রহমান
Printed Edition

৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে গেন্ডারিয়ার বাসা থেকে গোপনে বেরিয়ে চানখাঁরপুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেয় দশম শ্রেণীর ছাত্র আনাস। পুলিশের অবিরাম গুলির মধ্যে সেদিন ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে সংগ্রাম করে যান। একপর্যায়ে সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার। সেদিন আনাস বাসা থেকে গোপনে বের হওয়ার সময় স্কুলের খাতায় বাবা-মায়ের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে গিয়েছিল। ওই চিঠিতে লেখা ছিল ‘আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে গর্বিত হইয়ো। জীবনে প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।’

জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে আনাসসহ ছয়জন হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এক ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, চানখাঁরপুলের গণহত্যার তদন্তকাজ শেষ হয়েছে। ২০ এপ্রিল রোববার তদন্ত সংস্থা আমাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জুলাই আগস্টে গণহত্যার প্রথম কোনো ঘটনার তদন্তের কাজ শেষ হয়েছে।

প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার তথ্য ও প্রমাণাদি উঠে এসেছে : তাজুল ইসলাম জানান, এই প্রতিবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপির অপরাধের সম্পৃক্ততা এসেছে। তবে প্রধান আসামি শেখ হাসিনাসহ তার সুপিরিয়র কমান্ডারদের তদন্ত আলাদাভাবে হচ্ছে। জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের সর্বত্র যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে প্রত্যেকটা অপরাধের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। সে ক্ষেত্রে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিভিলিটির দায়ে তাদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের প্রক্রিয়া আছে। যেটা খুব সহসা আমরা আপনাদের সামনে পেশ করব। তিনি বলেন, সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে একটাই চার্জশিট দেয়া হবে। সেই কারণে এই চার্জশিটে তাদের বিচারের জন্য উপস্থিত করানো হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে তদন্ত রিপোর্ট আসবে। তাদের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হবে। তাদের সম্পৃক্ততার তথ্য ও প্রমাণাদি উঠে এসেছে।

শেখ হাসিনার কল রেকর্ড রয়েছে প্রতিবেদনে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে দু’টি অডিও রেকর্ড আছে। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল রেকর্ড আছে। যে কল রেকর্ডের মাধ্যমে তিনি পুলিশকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে এই আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেটি এখানে আছে। এর বাইরে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারণাস্ত্র ব্যবহার করে এই আন্দোলনকারীদের যে হত্যার নির্দেশ সেটা তিনি ওয়ারলেস মেসেজে পুরো পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সিআর অর্থাৎ চায়না রাইফেলের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবীদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। সেই অডিও রেকর্ডটিও পরীক্ষা করে এখানে প্রমাণ আকারে দাখিল করা হয়েছে।

এ মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য সাত আসামি হলেন- ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা জোনের সাবেক এডিসি শাহ আলম, রমনা জোনের সাবেক এসি মো: ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল ইমাদ হোসেন ও কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম।

তাদের মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- ইন্সপেক্টর আরশাদ, কনস্টেবল মো: সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন ও কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম।

চানখাঁরপুলে যারা শহীদ হন : রাজধানীর চানখাঁরপুলে এলাকায় আসামিরা নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। এতে শহীদ হন শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মো: ইয়াকুব, মো: রাকিব হাওলাদার, মো: ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়েছে- চানখাঁরপুলে গণহত্যার ঘটনার তদন্তকালে পলাতক আসামি হাবিবুর রহমানসহ অন্যান্য আসামিদের সরাসরি তত্ত্বাবধান বা সরাসরি অংশগ্রহণ, অধীনস্থদের নির্দেশ প্রদান, সহযোগিতা, সুযোগ তৈরি, সহায়তা এবং তিনি তার অধীনস্থদের মাধ্যমে নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড সংঘটন, উক্তরূপ অপরাধ সংঘটন হতে বিরত না রাখা কিংবা হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারীদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা না নেয়াসহ অন্যান্য উপায়ে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ৯০ পৃষ্ঠার। তদন্তে সময় লেগেছে ছয় মাস ১৩ দিন। মামলায় ৭৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দী নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই ঘটনার ১৯টি ভিডিও, ১১টি পত্রিকার রিপোর্ট, দু’টি অডিও, বই ও রিপোর্ট ১১টি এবং ছয়টি ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা হয়ে।

প্রতিবেদনের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, যারা সিনিয়র অফিসার তাদের বিরুদ্ধে কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির অভিযোগে এবং যারা সরাসরি গুলি করেছেন বিভিন্ন ভিডিওর মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে। যে কারণে এই আটজনের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পুলিশের আইজির সংশ্লিষ্টতাও রয়েছে।

চিফ প্রসিকিউটর আরো বলেন, এই রিপোর্ট পাওয়ার পর আমাদের এখন ফরমাল চার্জ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হবে। আগামী অল্প কিছুদিনের মধ্যে এটা আমরা আদালতে দাখিল করব। পরবর্তীতে আইনের যে প্রক্রিয়াগুলো আছে সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে।

তিনি বলেন, এই আটজনের বিরুদ্ধে যেসব ধারায় প্রমাণ পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে- ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ১৯৭৩ এর অ্যাক্ট ৩ এর (২), ৩ এর (২ এ, এফ, জি, এইচ) এবং ৪ এর (১), ৪ এর (২) ও ৪ এর (৩) ধারায় মানবতাবিরোধী অপরাধ।