সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফোনালাপে ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশের বিষয়টি গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রকাশ করা হয়েছে। উপসামরিক সচিব (ডিএসপিএম) কর্নেল রাজিবের সাথে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সেই কথোপকথনটি এদিন আদালতে শোনানো হয়।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গতকাল দ্বিতীয় দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে রাষ্ট্রপরে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
তাজুল ইসলাম শুরুতেই জুলাই-আগস্ট আন্দোলন নিয়ে নির্মিত দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রামাণ্যচিত্র তুলে ধরেন। এ ভিডিওতে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার ভূমিকা এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগের দুর্গ ভেঙে পড়ার বিবরণ দেয়া হয়। প্রতিবেদনটিতে হাসিনা এবং একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক কর্মকর্তার মধ্যে রেকর্ড করা একটি অডিও কথোপকথনের উল্লেখ ছিল। কল রেকর্ডে হাসিনা (কথিতভাবে) একজন কর্মকর্তাকে মিরপুর-১০, উত্তরা, এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে রাস্তায় জড়ো হওয়া শিার্থীদের ওপর আঘাত হানার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইসিটির প্রধান প্রসিকিউটর আদালতকে জানান, তদন্তকারীরা কথোপকথনে হাসিনার সাথে কথা বলা ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছেন।
ওই ভিডিওতেই একটি ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির এক কর্মকর্তার সাথে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপের কথা বলা হয়। পরে প্রসিকিউশনের প থেকে সেই অডিও রেকর্ডটি আদালতে শোনানো হয়। রেকর্ডকৃত ফোনালাপটিতে প্রথমে কল ধরতেই অপরপ্রান্তের ব্যক্তি ‘স্যার’ সম্বোধন করে সালাম দেন। ঠিক তখনই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় : ওরা কিন্তু জায়গায় জায়গায় এখন জমায়েত হতে শুরু করেছে। মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং বিভিন্ন জায়গায়। শুরুতেই কিন্তু ইয়ে... করতে হবে, একদম শুরুতেই। ধাওয়া দিলে এরা গলিতে গলিতে থাকবে। এবার আর কোনো কথা নাই। এবার শুরুতেই দিবা।’
এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালকে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনার সাথে কথোপকথনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি হলেন কর্নেল রাজিব, যিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন। এ নির্দেশটি গত বছরের ২৯ জুলাই ফোনের মাধ্যমে রাজিবকে দেয়া হয়।
তাজুল ইসলাম আদালতকে ব্যাখ্যা করে বলেন, শেখ হাসিনার শেষ কথা ছিল ‘এবার আর কোনো কথা নাই। এবার শুরুতেই দিবা।’ এর অর্থ হলো, আসামাত্রই যেন গুলি করা হয়- এটাই ছিল নির্দেশনা। তবে কর্নেল রাজিব বর্তমানে বাংলাদেশে নেই।
এরপর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা সরকার মতা গ্রহণের পর ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার যেসব অপরাধ করেছে তার বর্ণনা তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। এ সময় শেখ মুজিবের হাসিনার শাসনামলের সাথে শেখ হাসিনার শাসনের কিছু তুলনাও উপস্থাপন করেন তিনি। তাজুল বলেন, শেখ রহমান মানুষকে শুধু হত্যা করতেন। আর শেখ হাসিনা হত্যা এবং নির্যাতন দুই করতেন। শেখ মুজিব জনগণের সাথে রাজনীতি করে উঠে এসেছিলেন। আর শেখ হাসিনা বাপের বেটি হিসেবে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন।
এরপর আদালতে বদরুদ্দিন ওমর এবং মাহমুদুর রহমানের সাীর চুম্বক অংশ পড়ে শুনানো হয়। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে মতা গ্রহণের মাত্র দুই মাসের মধ্যে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। আর এ হত্যাকাণ্ডে শেখ ফজলে নূর তাপস জড়িত থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।
‘নিবেদিত প্রাণ আওয়ামী লীগার মোজাম্মেলের আত্মীয়স্বজন’ : শেখ মুজিবের শাসনের সময়কার স্বজনপ্রীতির ঘটনা আদালতের সামনে তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাসের ৮৫-৮৬ পৃষ্ঠা থেকে একটি ঘটনার বর্ণনা দেন। যার মূল বক্তব্য ছিল ‘নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগার মোজাম্মেলের আত্মীয়স্বজন’। এতে বলা হয়,
মোজাম্মেল ধরা পড়েছে মেজর নাসেরের হাতে। স্থান : টঙ্গী।
বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢোকামাত্র মোজাম্মেলের বাবা ও দুই ভাই কেঁদে বঙ্গবন্ধুর পায়ে পড়ল। টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতিও পায়ে ধরার চেষ্টা করলেন। পা খুঁজে পেলেন না। পা মোজাম্মেলের আত্মীয়স্বজনের দখলে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ঘটনা কী বলো।
টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, আমাদের মোজাম্মেল মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে। মেজর নাসের তাকে ধরেছে। নাসের বলেছে, তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দিবে।
মিথ্যা মামলাটা কী?
মোজাম্মেলের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, খুনের মামলা লাগায়ে দিয়েছে।
টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, এই মেজর আওয়ামী লীগ শুনলেই তারাবাতির মতো জ্বলে ওঠে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে- টঙ্গিতে আমি কোনো আওয়ামী লীগের বদ রাখব না। বঙ্গবন্ধু! আমি নিজেও এখন ভয়ে অস্থির। টঙ্গিতে থাকি না। ঢাকায় চলে এসেছি। (ক্রন্দন)
বঙ্গবন্ধু বললেন, কান্দিস না। কান্দার মতো কিছু ঘটে নাই। আমি এখনো বেঁচে আছি। মরে যাই নাই। ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি মোজাম্মেলকে তাৎণিকভাবে ছেড়ে দেয়ার আদেশ দিলেন। মেজর নাসেরকে টঙ্গি থেকে সরিয়ে দেয়ার জরুরি নির্দেশ দেয়া হলো।
মূল ঘটনা : এক নবদম্পতি গাড়িতে করে যাচ্ছিল। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোজাম্মেল দলবলসহ গাড়ি আটক করে। গাড়ির ড্রাইভার ও নববিবাহিত তরুণীর স্বামীকে হত্যা করে। মেয়েটিকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। মেয়েটির রক্তাক্ত লাশ তিনদিন পর টঙ্গী ব্রিজের নিচে পাওয়া যায়।
মেজর নাসেরের হাতে ধরা পড়ার পর মোজাম্মেল বলল, ঝামেলা না করে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে তিন লাখ টাকা দেবো। বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে নেবেন না। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি ছাড়া পাবো। আপনি পড়বেন বিপদে। আমি তুচ্ছ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চাই না।
মেজর নাসের বললেন, এটা তুচ্ছ বিষয়?
মোজাম্মেল জবাব দিলো না। উদাস চোখে তাকাল।
মেজর নাসের বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করব। তোমার তিন লাখ টাকা তুমি তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে রাখো।
মোজাম্মেল বলল, দেখা যাক।
মোজাম্মেল ছাড়া পেয়ে মেজর নাসেরকে তার বাসায় পাকা কাঁঠাল খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছিল।
হৃদয়ের লাশ রাতে কড্ডা নদীতে ফেলে দেয়া হয় : এরপর আরেকটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় কলেজছাত্র মো: হৃদয়কে হত্যা করে তার মরদেহ কড্ডা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। তার লাশ উদ্ধারে ডুবুরি নামানো হয়েছিল, তবে কিছুই পাওয়া যায়নি।
টাঙ্গাইলের গোপালপুরের আলমগর গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে হৃদয় লেখাপড়ার পাশাপাশি কোনাবাড়ী এলাকায় বসবাস করে অটোরিকশা চালাতেন। ট্রাইব্যুনালে সোমবার হৃদয় হত্যার একটি ভিডিও দেখানো হয়। সেখানে দেখা যায়, পুলিশের কয়েকজন সদস্য হৃদয়কে আটক করেছেন। রাস্তার ওপর পুলিশের সদস্যরা হৃদয়কে ঘিরে আছেন। এর মধ্যে পুলিশের এক সদস্য হৃদয়কে গুলি করেন। হৃদয় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর পুলিশ সদস্যরা পরে চলে যান। পরে পুলিশের দু-তিনজন সদস্য এসে হৃদয়কে টেনে নিয়ে যান। ভিডিও দেখানো শেষে ট্রাইব্যুনালে তাজুল ইসলাম বলেন, এ গুলি যে পুলিশ সদস্য করেছেন, তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছেন। লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে রাতে ব্রিজের ওপর থেকে কড্ডা নদীর একদম মাঝখানে ফেলে দেয়া হয়। এ পর্যন্ত স্বীকারোক্তি আছে। তার লাশ উদ্ধারের জন্য তারা ডুবুরি নামিয়েছিলেন। যেহেতু এক বছর পরে এবং সেখানে স্রোত আছে, কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। গ্রেফতার ওই কনস্টেবলের নাম মো: আকরাম হোসেন (২২)। তিনি গাজীপুর শিল্প পুলিশে কর্মরত ছিলেন।