শুনেছি আমার আসামি দিল্লিতে দেশে থাকলে কাজ সহজ হতো

শিক্ষার্থীদের উনি রাজাকারের বাচ্চা বলেন নাই। এই ট্রাইব্যুনালে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম তারা রাজাকারের বাচ্চা কিনা। সবাই অস্বীকার করেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে থাকলে যুক্তি উপস্থাপন অনেক সহজ হতো বলে মন্তব্য করেছেন আমির হোসেন। তিনি শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্কে তিনি এমন মনোভাব তুলে ধরেন।

মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম রয়েছে। তিন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন।

বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ শেখ হাসিনার এই মামলার বিচার চলছে। অপর দুই বিচারক হলেন মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার প্রসিকিউশন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছে। সোমবার থেকে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন আমির হোসেন। যা গতকাল মঙ্গলবারও অব্যাহত ছিল। আজ বুধবারও চলার কথা রয়েছে।

এ দিন যুক্তিতর্কের এ পর্যায়ে আমির হোসেন বলেন, ‘আমার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে শুনেছি। তবে উনি যদি আসতেন আমার পক্ষে অনেক কিছুই উপস্থাপন করা সম্ভব হতো।’ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিপক্ষে যেসব অভিযোগ এনে যুক্তি, তর্ক ও সাক্ষী উপস্থাপন করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাক্ষী রাষ্ট্রের, হাসপাতালও রাষ্ট্রের। সুতরাং আমার কাছে এসব গ্রহণযোগ্য নয়। তখন প্রসিকিউটর টিম থেকে বলা হয়, আবু সাঈদ হত্যা মামলার রিপোর্ট তৎকালীন সরকারের চাপে চারবার পরিবর্তন করা হয়েছিল। এই বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ আদালতের কাছে দেয়া হয়েছে। তখন হাসিনার আইনজীবী বলেন, তাহলে এখনোতো সরকারের চাপে অনেক কিছু হচ্ছে।

এর আগে যুক্তিতর্কের শুরুতে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ ধরে আমির হোসেন বলেন, বলা হয় যে, চীন সফর শেষে শেখ হাসিনা যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তাতে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছিল। আসলে এটি সঠিক নয়। রাষ্ট্রপক্ষের এই অভিযোগ আমি অস্বীকার করছি। শিক্ষার্থীদের উনি রাজাকারের বাচ্চা বলেন নাই। এই ট্রাইব্যুনালে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম তারা রাজাকারের বাচ্চা কিনা। সবাই অস্বীকার করেছে। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন যে হামলার নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়নি।

জুলাই আন্দোলনের সময় ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার অভিযোগ প্রসঙ্গে আমির হোসেন বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে ষড়যন্ত্রমূলক কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রতিদিন কোর কমিটির বৈঠক হতো বলে যে অভিযোগ তোলা হয় তা আংশিক সত্য। কারণ আন্দোলনকে প্রসমিত করার জন্য যদি কোনো কোর কমিটির বৈঠক হয়ে থাকে তবে সেখানে ষড়যন্ত্রের কোনো কিছু নেই। এটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য হতেই পারে।

লেথাল উইপেন ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে হাসিনার আইনজীবী বলেন, শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালের কথোপকথন থেকে হামলার উসকানিমূলক বক্তব্য পাওয়ার যে অভিযোগ রয়েছে এটাও ঠিক নয়। আসলে একটি আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যদি ড্রোন ব্যবহারের কথা হয় তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। বরং ড্রোন ব্যবহার করে লোকেট করে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় যে হত্যা হয়েছে সেটা শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশনা ছাড়া।

হেলিকপ্টর থেকে গুলির নির্দেশনা প্রসঙ্গে আমির হোসেন বলেন, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেছে এবং তাতে মানুষ মারা গেছে এমন কি কোনো প্রমাণ আছে? তখন আদালত বলেন, হেলিকপ্টর ব্যবহারের নির্দেশনা শেখ হাসিনা দিচ্ছেন এমন অডিও ট্রাইব্যুনালে শুনানো হয়েছে। আমির হোসেন তখন বলেন, কিন্তু এতে গুলির কথা বলা হয়নি। আদালত বলেন, কোমরের নিচে গুলির কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। এটা অডিওতে ছিল।

লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশনা প্রসঙ্গে আমির হোসেন বলেন, লেথাল উইপেন ব্যবহারের কথা বলা হলেও মানুষ মারার কথা বলা হয়নি। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালে যেসব ভয়েস রেকর্ড শুনানো হয়েছে তা কেবল সিআইডি থেকে ফরেনসিক টেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের কোনো সংস্থা থেকে নয়। তখন আদলত প্রশ্ন করেন, কাকে দিয়ে করালে সঠিক হতো? আমির হোসেন বলেন, বিদেশী কোনো সংস্থার মাধ্যমে পরীক্ষা করালে ভালো হতো। তখন আদালত বলেন, বিবিসি, আলজাজিরা তো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তাদেরটা কি গ্রহণ করা যাবে? আমির হোসেন বলেন সেটা আপনাদের সিদ্ধান্ত।

এর আগে বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সেনাকে শেখ হাসিনা মেরে ফেলবেন, সে আমি মানি না। এটা হলে শেখ হাসিনা এই বাহিনীর জন্য এতকিছু করতেন না। তিনি তো এদের বিচার করেছেন।’ শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমির হোসেন বলেন, “হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় এসেছে। পল্টন বায়তুল মোকাররম এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে। বড় বড় গাছ কেটেছে। তারা যেন রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে

শাপলা চত্বরে ৩০ জন মারা যাওয়া প্রসঙ্গে প্রসিকিউশনের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, আসলে ৩০ জন মারা গিয়েছে কিনা তা তিনি নিশ্চিত নন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ানসহ কয়েকটি পত্রিকায় এ ব্যাপারে রিপোর্ট হয়েছে

আমির হোসেন বলেন, “সত্য হলে একটিই সত্য, আর সত্য না হলে ১০টি রিপোর্টও সত্য হবে না।”

শেখ হাসিনার আমলের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রসিকিউশনের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ দাখিল করেনি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের কঠিন বিচার হয়েছে। আবরার, বিশ্বজিৎ, সাত খুন সব তার দলের লোক। তাদের বিচার হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ সঠিক নয়।”

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও এস কে সিনহার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার বিষয়ে তিনি বলেন, “খায়রুল হক ও এস কে সিনহার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করেননি। বিচার বিভাগ স্বাধীন। শেখ হাসনা তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের দুর্নীতির জন্য শেখ হাসিনা দায়ী নন।”

এর আগে, ১৬ অক্টোবর টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন প্রসিকিউশন। ওই দিন হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড (মৃত্যুদণ্ড) চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। একইসাথে রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেয়ায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের শাস্তির বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন তিনি।

টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্কে একাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগের ইতিহাসসহ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলের চিত্র তুলে ধরেন তিনি। গুম-খুন, হত্যাযজ্ঞের বর্ণনাও দেন তিনি। এ ছাড়া এ মামলায় গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়।

গত ৮ অক্টোবর মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো: আলমগীরকে তৃতীয় দিনের মতো জেরা শেষ করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন। এরপর যুক্তিতর্কের জন্য দিন নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়েছে। তবে নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে এরই মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনেন প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। এর আগে ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।