মেহেরুন ইসলাম
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে এটি একটি পরিবারের কষ্টের কারণ বা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। একটি অস্বাভাবিক শিশু মানেই সারাজীবন হতাশা, দুঃখ-কষ্ট বয়ে বেড়ানো। জন্মগত ত্রুটি হলো শিশুর জন্মের আগেই মাতৃগর্ভে থাকাকালীন ভ্রƒণের ত্রুটি ও অস্বাভাবিকত্ব। ২০১৫ সালে ১২টি সংস্থার সহায়তায় প্রথমবার বিশ্বব্যাপী ৩ মার্চ জন্মগত ত্রুটি দিবস পালিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতি ১০০ জন শিশুর মধ্যে তিন থেকে ছয়জন বড় ধরনের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় প্রতিবছর আট মিলিয়ন বাচ্চার ৬ ভাগ মারাত্মক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। এদের মধ্যে ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। শিশু মৃত্যুর চতুর্থ কারণ এটি। বিশ্বে ২ দশমিক ৭০ মিলিয়ন শিশু মারা যায় এ কারণে। বাকি ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন শিশু যারা মৃত্যু নামক বিষধর ছোবল থেকে রেহাই পায় তারা আজন্ম শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে বাঁচে।
জন্মগত ত্রুটি দুই প্রকার। যথা : ১.কাঠামোগত (Structural birth defect) ২. শারীরবৃত্তীয় (Functional birth defect)
কাঠামোগত ত্রুটি : জন্ম থেকেই অস্বাভাবিক, অকেজো, অসামঞ্জস্যতা বহন করে আসে। যেমন- হাত-পায়ের গঠন ত্রুটি, হার্টের সমস্যা, নার্ভ ডিজিজ, ক্রোমোজোমাল ডিজিজ (থ্যালাসেমিয়া, ডাউন সিনড্রোম)।
শারীরবৃত্তীয় ত্রুটি : খাদ্যরস পাচিত না হওয়ার কারণে বিপাকীয় সমস্যা, বুদ্ধিবৃত্তির অনুন্নতি, বধিরতা, দৃষ্টিস্বল্পতা হয়ে থাকে।
জন্মগত ত্রুটির কারণ : জন্মগত ত্রুটি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। যেমন- বংশগত, জিনগত, রক্তসম্পর্কীয় সমস্যা, খুব কম বা বেশি বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভকালীন ধূমপান, মদ্যপান, সংক্রামক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনাল সমস্যা, খিঁচুনি, অনিয়মিতভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন, তেজস্ক্রিয়তা, ভেজাল খাদ্য, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন। এ ছাড়াও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে অপুষ্টি ও দারিদ্র্যতার জন্য জন্মগত ত্রুটি বিশেষ প্রভাব ফেলে।
জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে ব্যবস্থা : জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
১. গর্ভধারণের আগেই পিতামাতার পূর্ব ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেমন- প্রথম বাচ্চা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মালে পরবর্তী বাচ্চারও ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া মায়ের ব্লাড গ্রুপ নেগেটিভ হলে বাচ্চা জন্মের পরে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে Anti-D immunoglobulin Injection দিতে হয়।
২. গর্ভধারণের পূর্বে পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। যেমন- ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন, ভিটামিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা।
৩. ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন করা। যেসব বাবা ধূমপান করে তাদের বাচ্চার চাইল্ডহুড ক্যান্সার (লিউকেমিয়া ও ব্রেইন টিউমার) হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে ধূমপানের কারণে তাদের DNA Mutations হয় যা তাদের অনাগত সন্তানের উপর ট্রান্সমিশন হয়।
৪. সঠিক বয়সে বাচ্চা নেয়া। ২০ বছরের আগে এবং ৩৫ এর পরে বাচ্চা নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। ৫. নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহে অধিক সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। বিশেষত রক্ত পরীক্ষা করা, থ্যালাসেমিয়ার বাহক আছে কি না যাচাই-বাছাই করা। ৬.জন্মগত ত্রুটিরোধে গর্ভধারণের পূর্বে Rubella Vaccine নেয়া। ৭. তেজস্ক্রিয় ও বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ থেকে নিরাপদে থাকা। ৮. পরিবেশ দূষণ ও পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করা। ৯. অপ্রয়োজনে ওষুধ সেবন না করা, করলেও রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শে করা। ১০. স্বাস্থ্যসম্মত ওজন বজায় রাখা। ১১. নিয়মিতভাবে গর্ভকালীন চেক-আপ করা।
যদিও জন্মগত ত্রুটি পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, সচেতনতা, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা, সঠিক গর্ভকালীন যতœ ও সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে পরিবার ও সমাজকে একসাথে সচেতন হতে হবে।
লেখিকা : সিনিয়র স্টাফ নার্স, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মোংলা, বাগেরহাট