‘আমি জানতাম, একটি গুলিতে একটি প্রাণ যাবে’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিচার; মানবতাবিরোধী অপরাধ

মানবতাবিরোধী মামলায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য অজয় ঘোষ গতকাল রোববার ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দীতে এ কথা বলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী মামলায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য অজয় ঘোষ গতকাল রোববার ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দেন। ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের প্যানেলের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অজয় বলেন, ‘আমি জানতাম, আমার রাইফেলের একটি গুলিতে একটি প্রাণ যাবে। তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ সত্ত্বেও আমি গুলি করিনি। কারণ ছাত্ররা ছিল নিরস্ত্র।’ অজয় ঘোষ বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ মানা অবশ্যই কর্তব্য, তবে সবক্ষেত্রে নয়। আমি নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ ছিলাম।’

অজয় ঘোষ এই মামলায় ১৫তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন। এদিন এই মামলায় আরো দু’জন সাক্ষী দিয়েছেন। মামলার ১৪তম সাক্ষী হিসেবে মো: সৌরভ আহমেদ এবং ১৬তম সাক্ষী হিসেবে আব্দুর রহমান জবানবন্দী দিয়েছেন। এ মামলায় পলাতক চার আসামির পক্ষে সাক্ষী অজয় ঘোষকে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুবউদ্দিন আহমেদ। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ান, তারেক আবদুল্লাহসহ প্রসিকিউশন টিমের অন্যরা। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১৮ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ট্রাইব্যুনালে চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন একজন পুলিশ সদস্য। তিনি গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় উপস্থিত ছিলেন। তার সামনেই ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে পুলিশ। রোববার সাক্ষ্য দেয়া পুলিশ সদস্যের নামেও একটি চাইনিজ রাইফেল ও ৪০ রাউন্ড গুলি ইস্যু করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করতে চাননি। এ কারণে তাকে গালাগালিসহ চাকরির ভয় দেখান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরপরও তিনি গুলি করেননি।

তিনি আরো বলেন, এই সাক্ষীর কাছ থেকে চাইনিজ রাইফেল কেড়ে নিয়ে সুজন নামে একজন কনস্টেবলের হাতে দেন ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আর সুজনের হাতে থাকা লাঠি ও ঢাল এনে এই সাক্ষীর হাতে দেয়া হয়। পরে সুজন-নাসিরুলরা ছাত্র-জনতার ওপর চায়নিজ রাইফেলে নির্বিচারে গুলি করেন। সেখানে ছয়জন ছাত্র নিহত হন। ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই সাক্ষী। এ ছাড়া গুলি করার আদেশ দেয়ার পরও গুলি করেননি বলে জানিয়েছেন তিনি।

সাক্ষী বলেন, ‘আমাকে গুলি করার আদেশ দেয়ার পরও গুলি করিনি। কারণ ছাত্র-জনতা নিরস্ত্র ছিলেন। আমি জানতাম আমার চাইনিজ রাইফেলের প্রত্যেকটি গুলি একটি করে প্রাণ নিতে পারে। এজন্যই আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পাওয়ার পরও গুলি করিনি।

এদিন সকালে কারাগার থেকে এ মামলার চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন- শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো: আরশেদ হোসেন, কনস্টেবল মো: সুজন মিয়া, মো: ইমাজ হোসেন ইমন ও মো: নাসিরুল ইসলাম।

পলাতক আসামিরা হলেন- সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ ঘোষ চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো: আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।

‘বেতন-রেশন খাস না, গুলি করবি না কেন?’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সময় সরকারের ঘোষিত কারফিউ অমান্য করে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে পুলিশি বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছিল। পুলিশ সদস্য আব্দুর রহমান তার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গতকাল রোববার আদালতে দাখিল করা জবানবন্দীতে বলেন, ‘বেতন-রেশন খাস না, গুলি করবি না কেন?’ এমন অকথ্য ভাষায় এডিসি আক্তার স্যার আমাদেরকে গালাগালি করেছিলেন এবং গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।’

আব্দুর রহমান সাক্ষীর ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি ২০১৭ সালের ৭ মে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগদান করি। পরে কনস্টেবল থেকে নায়েক পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৩ এপিবিএন উত্তরা, ঢাকায় যোগদান করি। বর্তমানে ওই পদে এবং ওই কর্মস্থলে কর্মরত আছি। ২৮ জুলাই ২০২৪ তারিখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১৩ এপিবিএন উত্তরা থেকে আমরা পিওএম মিরপুর পুলিশ লাইনে আসি। ২৯ জুলাই থেকে বিভিন্ন স্থানে ডিউটি করি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ছিল। ওই দিন সরকার কারফিউ ঘোষণা করেছিল। আমি নেতৃত্ব দিয়ে ২০ জন এপিবিএন পুলিশ সদস্য নিয়ে ভোর আনুমানিক ৪টায় শাহবাগ থানার উদ্দেশে রওনা দেই। আনুমানিক ৫টায় থানায় পৌঁছে অফিসার ইন চার্জকে রিপোর্ট করি। তিনি জানান, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং যুগ্ম কমিশনার সুদীপ ঘোষ চক্রবর্তী ছাত্র-জনতার উপর সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ ও গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ৯টায় এডিসি আক্তার স্যারের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ জন পুলিশ সদস্যকে ব্রিফ করেন, যেখানে সর্বোচ্চ বল প্রয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর আমরা শাহবাগ থানা থেকে শহীদ মিনারে যাই। সেখানে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে এডিসি আক্তার স্যারের নির্দেশে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করি।

সাড়ে ১০টার দিকে শহীদ মিনার থেকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট সংলগ্ন চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থান নেই। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ মিনারের দিকে আসার চেষ্টা করছিল। এডিসি আক্তার স্যারের নির্দেশে শটগান, গ্যাসগান ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করি, পরে তিনি চায়না রাইফেল ব্যবহারের নির্দেশ দেন। কিছু পুলিশ সদস্য চায়না রাইফেল ব্যবহারে অনিচ্ছুক থাকায় এডিসি আক্তার স্যার অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে বলেন, ‘বেতন-রেশন খাস না, গুলি করবি না কেন?’

এডিসি আক্তার স্যার কনস্টেবল অজয়ের কাছ থেকে চায়না রাইফেল নিয়ে কনস্টেবল সুজনকে দেন, আর সুজনের ঢাল ও লাঠি অজয়ের কাছে দেন। এরপর কনস্টেবল সুজন, নাসিরুল ও ইমাজ চায়না রাইফেল দিয়ে নবাবকাটারা, হানিফ ফ্লাইওভার, বকশীবাজার, নাজিমউদ্দিন রোডসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সেখানে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়। আমি গুলি করতে তাদেরকে সরাসরি দেখেছি।

পরবর্তীতে জানতে পারি ওই ঘটনায় ৬-৭ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি অবনতির কারণে এডিসি আক্তার স্যার সবাইকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে পিছন পথে শাহবাগ থানায় প্রবেশ করেন। তখন আনুমানিক বেলা আড়াইটা বাজে।

আমার নামে একটি এসএমজি ও ৬০ রাউন্ড গুলি ইস্যু ছিল। পরে আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে এডিসি আক্তার স্যারের নির্দেশে অস্ত্র ও গুলি শাহবাগ থানায় জমা দেই। আনুমানিক ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে সিভিল পোশাক পরে শাহবাগ থানার পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে ছাত্র-জনতার সাথে মিশে মিরপুরে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় যাই। ইন্সপেক্টর অপারেশন আরশাদ স্যার, কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল ইমাজ ও কনস্টেবল নাসিরুল তখনো সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

আমার পাশে একজন বুকের বাম পাশে গুলিবিদ্ধ হয় : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যাওয়ার পথে আমি আমার পাশে থাকা একজন আন্দোলনকারীকে বুকের বাম পাশে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখেছি। পুলিশি বাধার মুখে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপের সময় ওই আন্দোলনকারী গুরুতর আহত হয়। আমরা দ্রুত তাকে রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই, কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাজধানীর চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৪তম সাক্ষী হিসেবে গতকাল রোববার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মো: সৌরভ আহমেদ এই জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। এটি ছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে আমি রায়সাহেব বাজারের মেস থেকে সকাল ৯টায় বের হয়ে চানখাঁরপুল এলাকায় যাই। আমরা বহু সংখ্যক আন্দোলনকারী শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার সময় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে পৌঁছালে পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, রাবার বুলেট এবং গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন গলিতে আশ্রয় নিই। পুলিশের তীব্র গুলির মুখে আমি সহ আরো অনেকেই ১নং নবাবকাটারা রোডে আশ্রয় নিই। পুলিশের গুলিতে অনেক আন্দোলনকারী আহত হয়। আনুমানিক ১২টা থেকে ১টার মধ্যে আমার পাশে একজন আন্দোলনকারী বুকের বাম পাশে গুলিবিদ্ধ হয়।

আমি এবং আরেকজন আন্দোলনকারী তাকে রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই। পথে অন্য একজন আন্দোলনকারী রিকশা থেকে নেমে যায়। তার পরিচয় জানা না থাকার কারণে আমরা তাকে বেনামি টিকিট কেটে হাসপাতালে ভর্তি করি। কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমি তার পরিচয় জানার চেষ্টা করি। তার পকেটে থাকা একটি সীমবিহীন বাটন ফোন পাই। সেই ফোনে কয়েকটি নাম সেভ করা ছিল। ‘মা’ নামে একটি নম্বর সেভ ছিল। আমি ওই নম্বরে কল করি। একজন মহিলা ফোন রিসিভ করেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনাদের কেউ আন্দোলনে গিয়েছে কি না?’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আনাস আন্দোলনে গিয়েছে।’ আমি তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে আসতে বলি। আনাসের মা, বাবা ও নানা হাসপাতালে আসেন। আনাসকে দেখে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আনাসের মা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন। তার শরীরে রক্ত লেগে যায়।

আনাসের মৃত্যুর সনদ ও হাসপাতালের ভর্তি টিকিট আমি আনাসের মা-বাবাকে প্রদান করি। তারা আনাসকে বাসায় নিয়ে যান। পরবর্তীতে আনাসের বাবা-মাকে আনাসের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানাই। রিকশাযোগে আনাসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই ভিডিও করেছিল। রাব্বী নামের একজনও ভিডিও করেছিল। রাব্বীর ওই ভিডিও সংবলিত মোবাইলটি তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার সম্মুখে জব্দ করেন। আমি জব্দতালিকায় স্বাক্ষর প্রদান করি। এই ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পুলিশের উচ্চতর কর্মকর্তা ও যাদের আদেশে গুলি করা হয়েছিল তাদের বিচার দাবি করছি। যারা গুলি করেছে তাদেরও বিচার চাই।