জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঢাকায় ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড এবং সারা দেশে মোট তিন লাখ পাঁচ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্যদানকারী তদন্ত কর্মকর্তা মো: আলমগীর। গতকাল সোমবার তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার শীর্ষ দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে এ তথ্য আদালতে উপস্থাপন করেন।
আলমগীর জানান, পুলিশের সদর দফতর থেকে পাওয়া ২১৫ পৃষ্ঠার এক সরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আন্দোলন দমন করতে এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলভার, পিস্তলসহ বিভিন্ন মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। শুধু রাজধানী ঢাকায় ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড এবং সারা দেশে তিন লাখ পাঁচ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়।
গতকাল ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনে ব্যবহৃত গুলির পরিমাণ ও ধরন নিয়ে তথ্যচিত্র, ভিডিও ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়। মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো: আলমগীর দ্বিতীয় দিনের এ জবানবন্দী প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালে আন্দোলনের সময় শহীদ, আহত ও যোদ্ধাদের তালিকা এবং বিভিন্ন নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়। একই সাথে জুলাই আন্দোলনের নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরতে যমুনা টেলিভিশন, বিবিসি ও আলজাজিরার সম্প্রচারিত চারটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
আন্দোলনে ব্যবহৃত গুলির পরিমাণ সম্পর্কে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম জানান, ‘আন্দোলন দমন করতে মোট তিন লাখ পাঁচ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটি এলাকায় ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের জন্য ব্যবহার করা হয়।’
জুলাই আন্দোলনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন রাঙানো ছাত্র-জনতার প্রথম শহীদ আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের অষ্টম দিন ছিল সোমবার। নিহত আবু সাঈদের দুই সহপাঠী ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা দেন। তারা দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচারের দাবি করেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর শাস্তিও চান। আবু সাঈদের সহপাঠী আরমান হোসেন জানান, ‘বুক বরাবর গুলি চালানো হয়েছিল। সে প্রথমে পড়ে গেলেও আবার বুক তুলে দাঁড়িয়ে যায়, কিন্তু গুলির ধারা থামেনি। অবশেষে সে ডিভাইডারের পেছনে গিয়ে পড়ে।’ আন্দোলনের নৃশংসতায় সরকার ও পুলিশ কতটা দায়ী ছিল তা প্রমাণ করতে ট্রাইব্যুনালে আর্থিক ও মানবিক ক্ষতির বিস্তারিত তালিকা ও নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর আদালতে বলেন, ‘তদন্তকালে সংগৃহীত আলামত, পত্রপত্রিকা, ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, বই, বিশেষজ্ঞ মতামত, বিভিন্ন প্রতিবেদন, শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর জবানবন্দী এবং আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান তথা ‘জুলাই ৩৬’-এর সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পরিকল্পিতভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।’
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে নিরীহ, নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা ও হত্যাচেষ্টা, হাজার হাজারকে গুরুতর জখম ও অঙ্গহানি, নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, অপহরণ ও মিথ্যা মামলা দায়েরের মতো ভয়াবহ কর্মকাণ্ড ঘটে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই সময়ে জীবিত ও মৃত ব্যক্তিকে পুড়িয়ে দেয়া, চিকিৎসা ও জানাজা-দাফনে বাধা, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পরিবর্তনে চাপ প্রয়োগ, নিহতদের লাশ পরিবারকে না দিয়ে বেওয়ারিশ পরিচয়ে তড়িঘড়ি করে দাফন, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়, হাসপাতালে আহতদের ওপর আবার হামলা এবং আন্দোলনরত ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
ট্রাইব্যুনালে আলমগীরের এই সাক্ষ্য জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সংঘটিত নৃশংসতার একটি বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে। মামলার পরবর্তী শুনানিতে তার জবানবন্দীর বিষয়ে আসামিপক্ষ জেরা শুরু করবে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি ১৪ অক্টোবর : গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য আগামী ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। ইনুর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী নাজনীন নাহার।
এ দিন হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ওপর শুনানির জন্য এক সপ্তাহ সময় চান প্রসিকিউশন। তবে আসামির পক্ষে আরো দু’দিন বাড়িয়ে সময়ের আবেদন করেন নাজনীন নাহার। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আগামী ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে এ মামলায় ইনুকে সোমবার ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।
একই দিন সকালে ইনুর বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় সহযোগিতাসহ সুনির্দিষ্ট আটটি অভিযোগ এনে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপর শুনানিতে আটটি অভিযোগ উপস্থাপন করেন প্রসিকিউশন। শুনানি শেষে অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেন আদালত।
গত বছরের ২৬ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা থেকে হাসানুল হক ইনুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই জাসদ নেতা। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হিসেবে কুষ্টিয়ায় নিজ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে হেরে যান তিনি।
উত্তরার হত্যাকাণ্ডে ২ আ’লীগ নেতাকে হাজিরের নির্দেশ : জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর উত্তরায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এ দিন ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল নোমান। সাথে ছিলেন, প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার।
প্রসিকিউশনের পক্ষে ওই দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২২ অক্টোবর তাদের হাজিরের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
ওই দুই আওয়ামী লীগ নেতা হলেন মো: সোহেল রানা ও মো: শাহ আলম। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন তারা। এর মধ্যে সোহেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় ও শাহ আলমের নামে তেজগাঁও থানায় মামলা রয়েছে। তবে দু’জনই জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তরায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতার সাথে জড়িত বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের এ মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য আবেদন করা হয়।
এর আগে, ২৩ সেপ্টেম্বর এ মামলায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে আগামী ২২ অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন সকালে ৯ আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। আতিক ছাড়া অন্যরা হলেন- উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মো: শাহিনুর মিয়া, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: বশির উদ্দিন, ঢাকা মহানগর উত্তরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন।
দুই শিবির নেতাকে গুলির ঘটনায় ৩ পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি : যশোরের চৌগাছায় গ্রেফতারের পর বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে গুলি করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় উপপরিদর্শক (এসআই) আকিকুল ইসলামসহ তিন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এ দিন ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ান। তিনি এ মামলায় গ্রেফতার তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদের আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।
এসআই আকিকুল ছাড়া গ্রেফতার অন্য দু’জন হলেন- চৌগাছা থানার তৎকালীন কনস্টেবল সাজ্জাদুর রহমান ও কনস্টেবল জহরুল হক। এর আগে, ১০ সেপ্টেম্বর সাজ্জাদুরকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছে পুলিশ। ৯ সেপ্টেম্বর আকিকুলকে গ্রেফতার করে হাজির করা হয়।
২০১৬ সালে যশোরের চৌগাছা থানা এলাকায় মোটরসাইকেলে যাওয়ার পথে ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে গ্রেফতার করে থানায় নেয়া হয়। এরপর ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে পরিচয় জানার পর তাদের সাথে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী দু’জনকে আদালতে হাজিরের কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন রাতে তাদের চোখ বেঁধে অন্য স্থানে নিয়ে দুই হাঁটুতে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। পরে বন্দুকযুদ্ধে গুলি হয়েছে উল্লেখ করে আদালতে তোলা হয়। শুনানি শেষে তাদের দু’জনকে কারাগারে পাঠান আদালত। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই শিবির নেতারই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এরই অংশ হিসেবে চৌগাছার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়।