জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও গুলি চালানোর নির্দেশ থাকা একটি অডিও রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মিলে গেছে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ জানিয়েছেন একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনাল-২-এ সাক্ষ্য দিতে এসে সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক রুকনুজ্জামান বলেন, পরীক্ষা করার জন্য তাদের কাছে ওই রেকর্ডিং জমা দেয়া হয়েছিল।
তিনি ট্রাইব্যুনালে জানান, পরীক্ষায় নারীকণ্ঠ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এবং পুরুষকণ্ঠ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সাথে মিলে গেছে। আদালতে বাজানো অডিওতে ‘হাসিনা ও তাপসের’ কথোপকথন শোনা যায়। এই সিআইডি কর্মকর্তার জেরা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই ট্রাইব্যুনাল মধ্যাহ্ন বিরতিতে যায়।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা ও তাপসের মধ্যে হওয়া এই ফোনালাপের রেকর্ডিং মার্চ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া বহু অডিওর একটি। এসব অডিওর উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ন্যাশনাল টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। একই ফাঁস হওয়া অডিওর অংশ এর আগে চলতি মাসে বিবিসি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ফোনালাপের এই রেকর্ডিং আন্দোলন দমন নিয়ে হাসিনার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, যেখানে তাকে আন্দোলনকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে শোনা গেছে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ফরেনসিক প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে গৃহীত হলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তা গুরুত্বপূর্ণ মোড় আনতে পারে। ফরেনসিক যাচাইয়ের মাধ্যমে কণ্ঠস্বর শনাক্তকরণ বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো উচ্চ প্রোফাইল মামলায় এটি নজিরবিহীন।
আবু সাঈদ হত্যা : ফের সাক্ষ্য গ্রহণ ২৮ সেপ্টেম্বর
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে সপ্তম দিনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ দিন ধার্য করেন। প্যানেলের বাকি সদস্যরা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মঞ্জুরুল বাছিদ ও জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
এ দিন ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজের শুরুতেই ছয় নম্বর সাক্ষী সিয়াম আহসান আয়ানকে জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। পরে সাত নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দী নেয়া হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মঈনুল করিম ও আবদুস সোবহান তরফদার।
এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য দেন সিয়াম আহসান আয়ান। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তিনিই আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিতে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন। নিজের সাক্ষ্যতেও পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর পঞ্চম দিনের মতো জেরা শেষ হয়। ওই দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরিয়ান আনিসুর রহমানকে জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ৯ সেপ্টেম্বর চতুর্থ দিনে পাঁচ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আনিসুর রহমান। একই দিন এসআই মো: তরিকুল ইসলামও জবানবন্দী দেন। ওই দিন তরিকুলের জেরা শেষ করলেও আনিসুরের হয়নি।
৮ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য দেয়া রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: রাজিবুল ইসলামের জেরা শেষ করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ৭ সেপ্টেম্বর তিনি জবানবন্দী দেন। ওই দিন দ্বিতীয় সাক্ষী রংপুরে কর্মরত এনটিভির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এ কে এম মঈনুল হককেও জেরা করা হয়।
গত ২৮ আগস্ট জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের জবানবন্দীর মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ। একই দিন সাংবাদিক মঈনুল হক সাক্ষ্য দিলে জেরা হয়নি।
আসামিদের হাজিরা ও আইনগত প্রেক্ষাপট : সোমবার সকালেও এ মামলার ছয় আসামিকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন- এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ।
গত ২৭ আগস্ট সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর আগে গত ৬ আগস্ট ৩০ আসামির বিরুদ্ধে ফর্মাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
তবে এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসিসহ ২৪ জন এখনো পলাতক রয়েছেন। তাদের পক্ষে গত ২২ জুলাই সরকারি খরচে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়। গত ৩০ জুলাই পলাতক আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত চার আইনজীবী। এর মধ্যে পাঁচজনের হয়ে লড়েন আইনজীবী সুজাত মিয়া। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মামুনুর রশীদ। এ ছাড়া শুনানি করেন আইনজীবী ইশরাত জাহান ও শহিদুল ইসলাম।
২৯ জুলাই তিন আসামির পক্ষে শুনানি হয়। এর মধ্যে শরিফুলের হয়ে লড়েন আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো, কনস্টেবল সুজনের পক্ষে আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু ও ইমরানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সালাহউদ্দিন রিগ্যান।
২৮ জুলাই এ মামলার ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন। ৩০ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। আর ২৪ জুন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। এ মামলায় মোট সাক্ষী ৬২ জন।
বিশ্লেষণ : ফরেনসিক প্রমাণের গুরুত্ব : আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত মামলাগুলোতে ফরেনসিক প্রমাণের ব্যবহার বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। অডিও বা ডিজিটাল প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা, কণ্ঠস্বর শনাক্তকরণ ও এনটিএমসির রেকর্ড ফাঁস- সবকিছু মিলে এই মামলাগুলো এখন আর কেবল সাক্ষ্য-জবানবন্দীর ওপর নির্ভর করছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশের প্রমাণ যদি ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করে এবং তা আইনগতভাবে টিকে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ মামলাগুলো দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।