জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটে। ৩৬ দিনের আন্দোলনে দুই হাজারের মতো শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। ২৫ সহস্রাধিক মানুষ আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশ চালানোর দায়িত্ব পড়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে। তিনি নিপাট ভদ্রলোক। দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। তার ওপর চারপাশে ঘিরে আছে বেশির ভাগ বিগত সরকারের নিয়োজিত আমলা। তারা নানা কৌশলে ইউনূস সরকারের বিরোধিতা করে চলেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পতন ঘটাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নানা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। ভারত সরকারসহ ও সে দেশের গোটা মিডিয়া ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অদৃশ্য যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। অন্য দিকে দেশে প্রধান রাজনৈতিক দ্রুত নির্বাচন চাইছে।
শুরুতে প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে দু-একটি কথা বলা দরকার। তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব, সফল উদ্যোক্তা, নোবেলজয়ী ও মোটিভেশনাল স্পিকার। তার স্পিচ শুনতে কমপক্ষে ৭৫ হাজার ডলার খরচ করতে হয় বলে নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে। ক্ষেত্রবিশেষে অঙ্কটা লাখ ডলারও ছাড়িয়ে যায়। এত টাকা দিয়ে তাকে নিশ্চয় কেউ নিরর্থক আহ্বান করেন না। একটি মানুষের নলেজ লেভেল কোন্ মানের হলে শুধু কথা শুনতে মানুষ তার পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেন; তা আমরা বাংলাদেশীরা হয়তো অক্ষম। এত দামি কথাবার্তা বাংলাদেশের মানুষ মাগনা শুনছেন বলে হয়তো হজম করতে পারছেন না! এ ছাড়া ঐতিহাসিক কারণ তো আছেই। বিখ্যাত ব্যক্তিরা দুনিয়ার সব জায়গায় স্বদেশে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ মাসে বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ, কূটনৈতিক অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপর রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ লক্ষ্যে পৃথক কমিশন গঠন করেছে। সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যের প্রচেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে সব দলের সাথে ইউনূসের বৈঠক হয়েছে। সংস্কার বিষয়ে সব পক্ষ মোটামুটি ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে।
সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত কমিশন ইতোমধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা আরো কার্যকর করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে কমিশন কাজ করছে। নির্বাচন কমিশন সংস্কারের লক্ষ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিচারব্যবস্থা আরো কার্যকর করতে বিচারকদের নিয়োগ ও প্রেষণনীতিতে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যকারিতা বাড়াতে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এসব সংস্কারকে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়েছে ইউনূসের সরকার। বাজার তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা এবং মুদ্রানীতিতে কিছু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বিনিয়োগে আকর্ষণ বাড়াতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ কর ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। রফতানি খাত উজ্জীবিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে তৈরী পোশাক শিল্প চাঙ্গা করতে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছে।
অনলাইন জালিয়াতি, হ্যাকিং এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম ইউনিট সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ভুয়া তথ্য প্রচার ও ডিজিটাল প্রতারণা বন্ধে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।
ইউনূস সরকারের ১০ মাসের অন্যতম বড় সাফল্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুদৃঢ় হয়েছে এবং মানবাধিকার ইস্যুতে সরকার তার নীতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদারত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের সাথে আলোচনার নতুন ধারা শুরু হয়েছে, যদিও এখনো কার্যকর সমাধান আসেনি।
বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করতে সরকার কৌশলী ভূমিকা রাখছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন। সরকার বলছে, সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয় নিয়েও আলোচনা চলছে। কিন্তু দেশের কিছু মানুষ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সমালোচনার তীর নিক্ষেপ করে চলেছে। সরকারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে। দেশীয় মিডিয়ার একটি অংশের পাশাপাশি ভারতীয় মিডিয়াতেও তার তীব্র সমালোচনা করছেন কিছু নেতানেত্রী। পলাতক ফ্যাসিবাদীদের প্ররোচনায় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্রকারীরা এ কয় মাসে আড়াই শতাধিক আন্দোলন খাঁড়া করেছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো পক্ষ তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজধানী অচল করে দিচ্ছে। অথচ বিগত দেড় যুগেও এসব দাবি নিয়ে মুখ খোলেননি কেউ। আর হঠাৎ করে সব পক্ষ একযোগে মাঠে নেমে পরিকল্পিতভাবে ড. ইউনূসকে বিপদে ফেলতে চাইছে। এ ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে এখনো। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না।
হাসিনার নেয়া ঋণে জর্জরিত দেশকে বদলে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ড. ইউনূস। ইতোমধ্যে তিনি দেশী-বিদেশী ঋণ পরিশোধ করেছেন প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। হাসিনা ও তার পরিবারের অ্যাকাউন্ট থেকে উদ্ধার করেছেন প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
বর্তমান রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভের সর্ববৃহৎ অঙ্ক। বিগত রমজানে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কাকে দারুণভাবে হ্যান্ডেল করেছে ইন্টেরিম সরকার। এ সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল ভালো।
দেশে ধর্ষণের শাস্তির বিধান থাকলেও দীর্ঘসূত্রতা বিচার কার্যক্রমকে অকার্যকর করে ফেলেছিল। ইউনূস সরকার ধর্ষণের তদন্ত ১৫ দিন এবং বিচার ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আওয়ামী আমলে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির কারণে বাফুফের ওপর ফিফা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ইউনূস সরকারের উদ্যোগে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ফিফা।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে ৩২ বছর করা হয়েছে। স্কুলের বইগুলোতে হাসিনার উল্টাপাল্টা সিলেবাস আর পারিবারিক তোষামোদির গল্প বাদ দিয়ে সাজানো গোছানো একটি সিলেবাস উপহার দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব চার দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সফর ছিল দেশের জন্য অনন্য মর্যাদার। তার এ সফর ইন্টেরিম গভর্মেন্টের ওয়ার্ল্ডওয়াইড রিকগনিশন বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বলেছেন, আগামী বছর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে সেখানে তাদের সাথে ইফতার করবেন! এমন প্রস্তাবনা শুধু ড. ইউনূসের কারণে হয়েছে।
অনেক কিছু ইউনূসের বিরুদ্ধে আমরা বলতে পারি। কিন্তু হাসিনার রেখে যাওয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশ গঠন করা এত সহজ না। তলানীতে থাকা অর্থনীতি চাঙ্গা করাটা মোটেই সহজ নয়। বিগত ৫৪ বছরের শাসন দেশবাসী দেখেছেন। এই সময়ে শাসনের নামে বিগত সরকারগুলো আমাদের শোষণ উপহার দিয়েছে। মূলত এরা সবাই ছিল, ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার ও মাফিয়াচক্রের শক্তিশালী গডফাদার। এদের সবাই ছিল গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে লুটেরা। ৫৪ বছর ধরে এসব চক্র রাজনীতিকে লুটপাটের হাতিয়ার বানিয়েছিল। এ অনৈতিক লুটপাট আর পরিবারতন্ত্র থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চায় না। রাজনৈতিক গুণ্ডামি তাদের রক্তে মাংসে মিশে আছে। সে জন্য কোনো ভালো কাজ তাদের চোখে ভালো লাগে না।
ড. ইউনূসকে ব্যর্থ করতে চলছে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র। আর আধিপত্যবাদী ভারত সব শক্তি দিয়ে একজন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় দেশ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু ড. ইউনূস কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেননি। নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃত বাস্তবতায় তিনি আন্তর্জাতিক মানের নীরব খেলোয়াড়। এমন উঁচু মানের খেলোয়াড় বিশ্বে খুব বেশি নেই। তার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে টিকে থাকা সহজ হবে না। হয়তো সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে পেরে নিষ্ক্রিয় আছেন। এমতাবস্থায় রাজনীতিবিদদের আরেকটু সংযত আচরণ কাম্য। তাদের ভাবা উচিত সাধারণ মানুষ ড. ইউনূসের পক্ষে আছেন। তারা রাজনীতিকদের অধৈর্য দেখে বিরক্ত হচ্ছেন।
রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলতে চাই, ড. ইউনূস ক্ষমতায় থাকলেও দেশ চালাচ্ছেন মূলত আপনারা। সরকারে আপনাদের প্রতিনিধি আছে। প্রশাসনে আপনাদের মনোনীত লোকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শুধু দলীয় শাসন বাকি আছে। কিছু দিন অপেক্ষা করলে তাও পেয়ে যাবেন। ১৭ বছরের সব মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আপনাদের নেতারা কারামুক্ত হয়ে দেশে-বিদেশে সুচিকিৎসা নিতে পেরেছেন। ইচ্ছেমতো কথা বলতে পারছেন। দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে পারছেন।
সুতরাং ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়ান। তাকে সহযোগিতা করুন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুন্দর করতে তার পাশে দাঁড়ান। মাত্র একটি বছর। এই এক বছরে দেশ এবং দলকে বিনাবাধায় ঢেলে সাজান। প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। গণহত্যাকারী খুনিদের বিরুদ্ধে বিচার সম্পন্ন হতে দিন। দু-একটি বিচারের রায় জনগণকে দেখতে দিন। হাসিনা পালিয়ে গেছেন তার পাচারকৃত অর্থগুলো ফেরত আনার সুযোগ দিন। বাংলাদেশ তো ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে গিয়েছিল। হাসিনার বাংলাদেশ ভারতকে স্বামিত্বে বরণ করেছিল। এখনো যারা আওয়ামী লীগকে সেইভ করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন, তারা ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ তৈরি করতে চান সেটা সহজে অনুমেয়!
দেশ এখন ভারতের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পথে। মানুষ জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাদের ম্যান্ডেটকে সম্মান করুন। মনে রাখা দরকার, ড. ইউনূস শুধু নির্বাচন করার জন্য দায়িত্ব নেননি। তিনি দেশের জন্য, জাতির জন্য কিছু করতে চান। তাকে সময় ও সহযোগিতা দিন। ধৈর্য ধরুন! না হলে আম ছালা দুটোই হারানোর ঝুঁকি থেকে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া