শওকত আরা বেগম
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারী কিংবা অর্থনৈতিক ধাক্কা- যখনই দুর্যোগ আসে, তখন মানুষের সবচেয়ে বড় চাহিদা হয়ে ওঠে খাদ্যনিরাপত্তা। ক্ষুধা শুধু পেটের খিদেই নয়; বরং তা হয়ে ওঠে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম) তাদের নিয়মিত প্রোগ্রামের আওতায় রেখেছে ইনসানিয়াত ডিপার্টমেন্টের অধীনে জরুরি মানবিক খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি। একটি এলাকায় জীবিকা উন্নয়ন কর্মসূচির সূচনা হলে সেখানে বিশেষ জরিপের মাধ্যমে বাছাই করা হয় সেসব দুস্থ, প্রতিবন্ধী, অকর্মক্ষম বয়সের ভারে ন্যুব্জ নারী-পুরুষ ও অসহায় এতিম শিশুকে যাদেরকে বিশেষ খাদ্যসহায়তা না দিলে তাদের জন্য জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। তাদের সুপরিকল্পিত প্রোগ্রামের মাধ্যমে এসব সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র ব্যক্তিদের কাছে দ্রুত ও কার্যকর খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দিয়ে আসে সিজেডএমের মাঠকর্মীরা।
যাদের কাছে পৌঁছায় এই প্যাকেজ
প্রতি মাসে সিজেডএম খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেয় নানা শ্রেণীর মানুষের কাছে। শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অকর্মক্ষম ব্যক্তি প্রায় ৭০০ জন, বিধবা ও এতিম সন্তানসহ পরিবার ২০০ জন, এতিম ও দুস্থদের জন্য মাদরাসা ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সহায়তা প্রায় ১০০ জন, প্রতিবন্ধী ১৫ জন, এতিম ও দুস্থ ৫০০ জনসহ বিবিধ ক্যাটাগরিতে আরো অনেকে সহায়তা পেয়েছে। এসব ব্যক্তির কাছে মাস ভিত্তিতে খাবার ও টাকা পৌঁছে দেয়া হয় দৈনিক তিনবেলা খাবারের চাহিদা মাথায় রেখে। এ ছাড়া রমজান মাস, ঈদুল ফিতর ও কোরবানির গোশত বিতরণ কর্মসূচিও খাদ্যসহায়তার অন্তর্ভুক্ত। এই বহুমাত্রিক সহায়তা প্রমাণ করে, সিজিএম শুধু খাদ্য বিতরণ করছে না; বরং সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও অবহেলিত শ্রেণীর মানুষকে মর্যাদাসহকারে টিকিয়ে রাখছে। এই পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, সিজেডএমের খাদ্যসহায়তায় শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
মাসিক ফুড প্যাকেজ ও বৈশ্বিক মানদণ্ড
বৈশ্বিক মানবিক মানদণ্ড নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান Sphere Project জরুরি অবস্থায় প্রতি ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন অন্তত দুই হাজার ১০০ ক্যালোরি খাদ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির জন্য দৈনিক গড়ে এক হাজার ৮০০ ক্যালোরি প্রয়োজন (FAO/WHO), নারী ১৮০০-২২০০, পুরুষ ২২০০-২৭০০ ক্যালোরি (EU), নারী-২০০০, পুরুষ-২৫০০ ক্যালোরি (NHS/USDA)।
এই ক্যালোরি সাধারণত শস্য, ডাল, তেল, চিনি ও প্রোটিনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। এর চেয়ে কম হলে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী অপুষ্টিতে ভোগে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্যচক্র থেকে বের হতে পারে না। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট তাদের ইমার্জেন্সি ফুড সাপোর্ট কর্মসূচিতে প্রতিটি খাদ্যপ্যাক বৈজ্ঞানিকভাবে পরিকল্পনা করে দেয়, যাতে পুষ্টি ও ক্যালোরির মান বজায় থাকে। জনপ্রতি হিসাবে প্রতি মাসে যে ফুড প্যাকেজ তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়, তাতে মূল উপাদান থাকে- চাল, আটা, আলু, ডাল, তেল, চিনি, ছোলা, গুঁড়াদুধ, সেমাই ও ডিম। এক মাসে এগুলো থেকে পাওয়া যায় প্রায় ৮৪ হাজার ২৯০ ক্যালোরি, অর্থাৎ দৈনিক গড়ে প্রায় দুই হাজার ৮১০ ক্যালোরি।
এর পাশাপাশি প্রতিজনকে মাসে ৬১৫ টাকা দেয়া হয় দুধ, মাছ, সবজি ও ফল কেনার জন্য, যা গড়ে আরো চার হাজার ৩৯৫ ক্যালোরি যোগ করে। সবমিলিয়ে প্রতিজনের জন্য মাসে ৮৮ হাজার ৬৮৫ ক্যালোরি বা দৈনিক প্রায় দুই হাজার ৯৫৬ ক্যালোরি নিশ্চিত হয়। সিজেডএমের খাদ্যপ্যাক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন প্রতি ব্যক্তির জন্য প্রায় ২১৩০-২৩৫০ ক্যালরি, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্ধারিত দুই হাজার ১০০ ক্যালোরির চেয়ে বেশি। এর প্রভাবে দেখা গেছে, পরিবারের দৈনিক খাবারের সংখ্যা ১ দশমিত তিন বেলা থেকে বেড়ে তিন বেলায় দাঁড়িয়েছে। শিশু অপুষ্টি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। মৌসুমি সহায়তা (রমজান প্যাক ও কোরবানির গোশত) শতভাগ লক্ষ্যভুক্ত পরিবারে পৌঁছেছে এবং সুবিধাভোগীদের সন্তুষ্টি ছিল প্রায় শতভাগ।
জরুরি খাদ্যসহায়তায় ইসলামী সামাজিক অর্থায়নের শক্তি
এই খাদ্যসহায়তা কেবল পুষ্টি ও ক্যালোরির হিসাব মেটায় না; বরং মর্যাদা রক্ষার দিকেও গুরুত্ব দেয়। প্রতিটি প্যাকেজ স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়। যেমন- রমজানে ইফতার-সামগ্রী, কোরবানিতে গোশত, শীতে পুষ্টিকর খাদ্য। এতে উপকারভোগীরা কেবল সহায়তা পাওয়া মানুষ নন; বরং মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে অনুভব করেন।
এই সহায়তার প্রভাব চোখে পড়ার মতো। আগে যেখানে পরিবারগুলো দিনে গড়ে একবার বা দেড়বার খেতে পারত, সেখানে সহায়তার পর তারা পূর্ণ তিনবেলা খাবার পাচ্ছে। শিশু অপুষ্টি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। রমজান ও কোরবানির সময়ে প্রায় শতভাগ পরিবার বিশেষ খাদ্যসহায়তা পেয়েছে।
এই খাদ্যসহায়তার মূল চালিকাশক্তি হলো ইসলামী সামাজিক অর্থায়ন- জাকাত, সাদাকাহ ও ওয়াক্ফ। জাকাতের বাধ্যতামূলক দান দ্রæত বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেয়া যায়, সাদাকাহ ডিজিটাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের মুসলমানদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়, আর ওয়াক্ফ দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যব্যাংক ও গুদাম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই অর্থায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি জরুরি ত্রাণকেই রূপান্তর করছে টেকসই মানবিক ব্যবস্থায়।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
যদিও সিজেডএমের উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মান ছাড়িয়ে গেছে, তবুও চ্যালেঞ্জ রয়েছে- ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, সরবরাহ ঘাটতি এবং জীবিকা-সংযুক্তি ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে নির্ভরশীলতার ঝুঁকি। একই সাথে জাকাত ও ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার ঘাটতিও আছে। এসব অতিক্রম করতে প্রযুক্তি, বøøকচেইনভিত্তিক স্বচ্ছতা এবং স্থানীয়-আন্তর্জাতিক সমন্বয় অপরিহার্য। বিশ্বব্যাপী জাকাতের সম্ভাবনা বছরে ৬০০ বিলিয়ন থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলার। এর সামান্য অংশও যদি স্বচ্ছ কাঠামোয় ব্যবহৃত হয়, তবে কোনো মুসলমানকে দুর্যোগকালে ক্ষুধার্ত থাকতে হবে না।
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, যেখানে দুর্যোগ বারবার আসবে। বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি ও ফসল না ফলাতে পারা, অসুখে-অভাবে না খেতে পেয়ে বা চিকিৎসার অভাবে রোগবালাইয়ে বিপর্যস্ত হয়ে, অপুষ্টিজনিত ঝুঁকিতে পড়া- এরকম আছে হাজারো সঙ্কট। এই সঙ্কট মোকাবেলয় সরকারি উদ্যোগ শুধু যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন হলেও তা প্রায়ই বিলম্বিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে সিজেডএমের জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রমাণ করেছে- ইসলামী সামাজিক অর্থায়ন কেবল আধ্যাত্মিক কল্যাণের জন্যই নয়; বরং তা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যবিমোচনে কার্যকর অর্থনৈতিক ও মানবিক সমাধানও বটে।
আজকের এই লেখা শুধু দৈনিক তিনবেলা খাবারের গল্প নয়। এটি ন্যায়, মর্যাদা আর সহনশীলতার গল্প। সিজেডএম দেখিয়ে দিচ্ছে- ইসলামী সামাজিক অর্থায়নের শক্তিতে কিভাবে দুর্যোগে মানুষকে কেবল বাঁচানোই নয়; বরং ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী করে তোলা যায়। যখন একটি ফুড প্যাকেজ শুধু ক্ষুধা মেটায় না; বরং বিশ্বমানের ক্যালরির চাহিদা ছাড়িয়ে যায় এবং সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীর মানুষকে মর্যাদাসহ বাঁচিয়ে রাখে, তখন তা হয়ে ওঠে ন্যায়বিচার, সংহতি ও আশার প্রতীক।
লেখক : কনসালট্যান্ট, আইআইএফসি, সিজেডএম