৭ নভেম্বর ও ৫ আগস্ট

৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এবং ৫ আগস্ট ২০২৪, এ দু’টি দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা থাকবে। উভয় দিনেরই রয়েছে গভীর তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব। দুই ক্ষেত্রেই জনতার নিশানা ছিল স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসন। শেখ মুজিবের অপশাসনের ফল ছিল ৭ নভেম্বর ১৯৭৫, আর শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের ফল ৫ আগস্ট ২০২৪। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভূমিকা রাখলেও, মুজিব ও তার কন্যার যুগে এ দলটি পরিণত হয়েছে এক স্বৈরাচারী রাজনৈতিক শক্তিতে।

শেখ মুজিবের যুগকে বলা হয় এক অন্ধকার অধ্যায়, যা শেষ হয় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ একটি জনপ্রিয় সামরিক অভ্যুত্থানে। সেই পরিবর্তন স্থায়ী হয়নি; ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। বাংলাদেশের মানুষ ও সৈনিকরা এই দখলদারিত্ব মেনে নেয়নি; ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারা বিপ্লব ঘটায়।

৭ নভেম্বরের সৈনিক-জনতার বিপ্লব জাতিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা থেকে মুক্ত করে এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয় জিয়াউর রহমানের হাতে। যথার্থই বলা হয়- জিয়াউর রহমান যেমন সৈনিক-জনতার বিপ্লবের ফসল, তেমনি নেপোলিয়ন ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের ফসল। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান নিজেকে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি জাতির অর্পিত দায়িত্বে সার্থক প্রমাণিত হন।

বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের গৃহীত রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো জাতির জন্য ছিল সময়োপযোগী ও অত্যন্ত কার্যকর। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রভাব ও আধিপত্য থেকে মুক্তির স্বাদ পায় যে আধিপত্যের সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই।

৭ নভেম্বরের বিপ্লব দেশে গণতন্ত্রের ভিত স্থাপন করে যা শেখ মুজিবের সরকার ধ্বংস করেছিল। জিয়াউর রহমানের গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে বিদেশী প্রভুত্বমুক্ত এক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যেখানে শেখ মুজিব ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে জিয়াউর রহমান সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি প্রশাসনকে সুশাসনের পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হন, যা শেখ মুজিব পারেননি।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখন শেখ মুজিব তার জনগণকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন জিয়াউর রহমানই এগিয়ে এসেছিলেন জাতিকে রক্ষার জন্য। নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসন চালনায় শেখ মুজিব ছিলেন ব্যর্থ; কিন্তু জিয়াউর রহমান অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তাই শেখ মুজিবকে ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আর জিয়াউর রহমান জাতির ইতিহাসে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্থান পান। সততা, আন্তরিকতা ও প্রজ্ঞাই ছিল তার রাজনৈতিক সাফল্যের মূল রহস্য, যা তাকে এক কিংবদন্তিতে পরিণত করে।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় ৫ আগস্ট যা জাতির জন্য এক নজিরবিহীন আশীর্বাদ। এটি শুধু শেখ হাসিনার দমনমূলক শাসন থেকে আমাদের মুক্ত করেনি; বরং ভারতের প্রভাব থেকেও মুক্তি এনে দিয়েছে। আমাদের সামনে এখন নতুন রাজনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে, যদিও পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের আশাবাদী করছে না।

কোনো টেকসই পরিবর্তনের জন্য নেতৃত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কোথাও ভালো কিছু হয় না। জুলাই বিপ্লব আমাদের সে সুযোগ এনে দিয়েছে; কিন্তু আমরা এখনো সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলো দেখতে পাইনি। এটিই এখন জাতির প্রধান উদ্বেগ। ৭ নভেম্বর যেমন জন্ম দিয়েছিল এক মহান নেতা জিয়াউর রহমানকে, ৫ আগস্ট তেমনি জন্ম দিয়েছে তরুণ ছাত্রনেতাদের এক দলকে যারা বিপ্লবকে অপ্রত্যাশিত সাফল্যের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল এক অলৌকিক ঘটনা যেখানে জাতি মুক্তি পেয়েছিল ফ্যাসিবাদী শাসনের হাত থেকে। তবে জুলাই বিপ্লবের সময় ও পরবর্তীকালে একক কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতার আবির্ভাব ঘটেনি। বহু বিশ্লেষক মনে করেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবেরই ফলশ্রুতি হলো নতুন রাজনৈতিক শক্তি-এনসিপির জন্ম।

যেহেতু কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতা আবির্ভূত হননি, তাই দায়িত্ব এসে পড়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাঁধে। কিন্তু তারা সেই সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। বৈষম্যহীন সমাজগঠনের লক্ষ্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে।

জাতি চায় ঐক্য; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিভেদমূলক আচরণে সেই ঐক্যকে ভঙ্গ করছে। জুলাই বিপ্লবের সময় অর্জিত জাতীয় ঐক্য আজ ঝুঁকির মুখে। ভুলে গেলে চলবে না, জীবনে সুযোগ দ্বিতীয়বার আসে না। দেশ এখন এক সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে; তাই রাজনৈতিক দলের সততা, প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ৫ আগস্টের অর্জন অর্থবহ হয়।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ৭ নভেম্বর ও ৫ আগস্ট উভয় ঘটনার পটভূমিতে একাধিক মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের পরিণতি তাদের পতনে গিয়ে ঠেকেছে। ১৯৭৫ সালের আগস্ট বিপ্লবের পর বিএনপি যেমন জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে জাতিকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছিল, তেমনি জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়েও সেই দায়িত্ব তাদের কাঁধেই এসে পড়েছে। এখন প্রয়োজন প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও সঠিক দিকনির্দেশনা।

উভয় বিপ্লবের পেছনে এক অদৃশ্য মেধাবী কৌশল কাজ করেছে দূর থেকে। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এবং ৫ আগস্ট ২০২৪ উভয় ক্ষেত্রেই ভারত পরাজিত হয়েছে। দু’টি বিপ্লবই জাতিকে অসহনীয় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। উভয় বিপ্লবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

জাতি এখনো সঙ্কটমুক্ত নয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই জুলাই চার্টারের শর্তাবলি মেনে চলতে হবে যা তারা স¤প্রতি স্বাক্ষর করেছে। জনগণ এখনো বিশ্বাস রাখে যে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি এই তিন রাজনৈতিক দল দেশ ও জনগণের জন্য নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এই সঙ্কট মোকাবেলায় রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে জাতিকে নিরাপদ পথে নিতে পারবে- এটিই জনগণের প্রত্যাশা। আসন্ন নির্বাচন আমাদের একটি সুশাসিত ও নিরাপদ বাংলাদেশ উপহার দিতে পারে।