আজারবাইজান-আর্মেনিয়া চুক্তি : মৈত্রীর সেতু নাকি ভূরাজনীতির ফাঁদ

দক্ষিণ ককেশাসে এর আগেও অনেক ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তি হয়েছে, কিন্তু অসমাধিত ক্ষোভ ও ক্ষমতার পালাবদলে তা ভেঙে পড়েছে। টিআরআইপিপি ব্যতিক্রম হতে পারে, তবে শর্ত একটাই- এটি হতে হবে সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে। অন্যথায়, ৯৯ বছরের এ করিডোর হতে পারে ভবিষ্যতের নতুন প্রতিযোগিতা ও সঙ্ঘাতের সূচনাবিন্দু, যেখানে আপাত শান্তি কেবল পরবর্তী ঝড়ের আগে সাময়িক বিরতি মাত্র।

মো: ওবায়দুল্লাহ ও মেহেরাব হোসাইন
দক্ষিণ ককেশাস বহুদিন ধরে ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যপথ, জ্বালানি সরবরাহ ও কৌশলগত রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। কাস্পিয়ান সাগরের তেল-গ্যাস, রাশিয়া-তুরস্ক-ইরানের ক্ষমতার টানাপড়েন এবং পশ্চিমা বিশ্বের ভ‚রাজনৈতিক হিসাব- সবমিলিয়ে ছোট এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বারবার আলোচনায় এসেছে। তিন দশকের সঙ্ঘাত, ২০২০ সালের ৪৪ দিনের যুদ্ধ এবং ২০২৩ সালে নাগরনো-কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়ানদের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির পর, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আবারো আলোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আগস্টের শুরুতে ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে বসেন আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান ও আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ। বহু বছরের উত্তেজনার পর তাদের হাত মেলানো ঘিরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া পড়ে। চুক্তির নাম রাখা হয়েছে ‘ট্রাম্প রুট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড প্রস্পেরিটি বা সংক্ষেপে টিআরআইপিপি।

এ চুক্তির আওতায় আর্মেনিয়ার সিউনিক প্রদেশ দিয়ে আজারবাইজান ও তার নাখচিভান এক্সক্লেভকে সরাসরি যুক্ত করতে রেললাইন, জ্বালানি পরিবহন অবকাঠামো ও ফাইবার-অপটিক নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা হবে। পুরো উন্নয়ন ও পরিচালনার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকবে। এ চুক্তির ব্যাপ্তিকাল হবে ৯৯ বছর। বলাই বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি এক কৌশলগত সাফল্য। রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ ককেশাসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার, ইরানের একমাত্র আর্মেনিয়া সীমান্তকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব মজবুত করা- সব এ উদ্যোগের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। তুরস্কের জন্য এটি মধ্য এশিয়ার তুর্কি ভাষাভাষী দেশগুলোর সাথে স্থল সংযোগের স্বপ্ন বাস্তব রূপ দেবে। আজারবাইজানের জন্য এটি বহুদিনের লক্ষ্য- নাখচিভান ও মূল ভ‚খণ্ডের মধ্যে স্থলপথ তৈরি। এ পথ তুরস্কের সাথে দেশটির বাণিজ্য ও যোগাযোগ আরো দ্রুত ও সহজ করবে, যা ‘তুর্কি বিশ্ব’কে যুক্ত করার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ।

তবে আর্মেনিয়ার কাছে এ চুক্তির বাস্তবতা দ্বিমুখী। এক দিকে এটি আঞ্চলিক পরিবহন নেটওয়ার্কে যোগ দিয়ে তুরস্ক ও ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ এনে দিতে পারে, বিদেশী বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। অন্য দিকে বড় আশঙ্কা করিডোরটি যেন সার্বভৌমত্ব খর্ব না করে। আর্মেনিয়া চায় করিডোর তার আইনের আওতায় চলুক, পাসপোর্ট ও কাস্টমস নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকুক। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র ও আজারবাইজান-তুরস্কের প্রভাব এতটা প্রবল যে, আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে সীমিত হয়ে যেতে পারে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নাগরনো-কারাবাখ থেকে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক আর্মেনিয়ানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিয়ে অনিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ফেরার অনুমতি দিলেও, চুক্তিতে কোনো বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নেই। আর্মেনিয়ার শঙ্কা, ন্যায়বিচারহীন এ ধরনের শান্তি ভবিষ্যতে নতুন ক্ষোভ ও সঙ্ঘাতের জন্ম দিতে পারে।

আজারবাইজান এ চুক্তিকে বড় কৌশলগত বিজয় হিসেবে দেখছে। দেশটির মতে, করিডোরটি শুধু আঞ্চলিক বাণিজ্য নয়, বৈশ্বিক রুটের বিকল্পও তৈরি করবে। রাশিয়া ও ইরাননির্ভর পথের বাইরে ইউরোপ-এশিয়া সংযোগে দক্ষিণ ককেশাসের গুরুত্ব বাড়বে। একই সাথে দেশটি এ-ও মনে করে, শান্তিচুক্তি দীর্ঘস্থায়ী করতে আর্মেনিয়াকে সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের কোনো সরকার আবার নাগরনো-কারাবাখের দাবি তুলতে না পারে। আর্মেনিয়া বলছে, সংবিধান পরিবর্তন অভ্যন্তরীণ বিষয়, কিন্তু আজারবাইজান এটিকে শান্তির পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে রেখেছে। এ অবস্থানগত ব্যবধান এখনো দূর হয়নি।

আলোচনার ইতিহাসও এ প্রক্রিয়ার জটিলতা বোঝায়। ২০২০ সালের যুদ্ধ শেষে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হলেও, মূল সমস্যাগুলো অমীমাংসিত থেকে যায়। ২০২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন করে মধ্যস্থতায় আসে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর নাগরনো-কারাবাখে আজারবাইজানি সামরিক অভিযানের পর আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটে, যা আলোচনার পরিবেশ আরো উত্তপ্ত করে। এরপরও ২০২৫ সালের মার্চে দুই দেশ ১৭ দফা শান্তিচুক্তির খসড়ায় ঐকমত্যে পৌঁছায়, যদিও দু’টি বড় প্রশ্ন- সীমান্তে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি ও পারস্পরিক আইনি দাবি প্রত্যাহার অমীমাংসিত রয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে টিআরআইপিপি আরো বড় শক্তির সমীকরণ বদলে দিচ্ছে। রাশিয়া, যা ২০২০ সালের যুদ্ধের পর আর্মেনিয়ার প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার ছিল, এখন আলোচনার বাইরে। ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় মস্কোর প্রভাব কমেছে। মস্কো আশঙ্কা করছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক দক্ষিণ ককেশাসে স্থায়ী উপস্থিতি গড়ে তুলবে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার কৌশলগত পরিসর সঙ্কুচিত করবে। ইরানের জন্য এ করিডোর বড় ধাক্কা। আর্মেনিয়া সীমান্তে সার্বভৌমত্ব হারানো মানে তাদের উত্তর-দক্ষিণ করিডোর দুর্বল হবে, যা ভারত ও রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যের জন্য জরুরি। তেহরান স্পষ্ট করে বলেছে, এ সীমান্তে কোনো ধরনের বাইরের নিয়ন্ত্রণ তাদের জন্য ‘রেড লাইন’। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে ইরানের প্রতিক্রিয়া সীমিত হতে পারে।

তুরস্ক এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক বিজয়ী। করিডোরটি শুধু তাদের মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বাড়াবে না; বরং ন্যাটোর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একটি কৌশলগত স্থলপথ তৈরি করবে। এর ফলে তুরস্ক ইউরোপীয় ও এশীয় বাজারের মধ্যে একটি প্রধান ট্রানজিট হাবে পরিণত হবে। একই সাথে তারা রাশিয়ার প্রভাব হ্রাসের সুযোগ নিচ্ছে, যদিও মস্কোর সাথে সরাসরি সঙ্ঘাতে না গিয়ে সমঝোতার পথও খোলা রাখছে।

টিআরআইপিপি বাস্তবায়িত হলে সম্ভাব্য সুফলও রয়েছে। দক্ষিণ ককেশাসে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহন বাড়বে, ইউরোপ-এশিয়া করিডোরের নতুন পথ তৈরি হবে, আর্মেনিয়া তুরস্ক ও ইউরোপীয় বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার পাবে, আজারবাইজান নাখচিভানকে সরাসরি যুক্ত করে ভ‚রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াবে। তবে ঝুঁকিও কম নয়। আর্মেনিয়ার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে, বাস্তুচ্যুত জনগণের প্রত্যাবর্তন অনির্দিষ্ট থাকবে, রাশিয়া বা ইরানের প্রতিক্রিয়ায় নতুন উত্তেজনা তৈরি হতে পারে, আর ক্ষমতার পালাবদলে চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।

এ বাস্তবতায় টিআরআইপিপি যেন একপক্ষের কৌশলগত বিজয় হয়ে না দাঁড়ায়, তার জন্য উভয় পক্ষের আস্থা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। করিডোরের আইনি ও নিরাপত্তাকাঠামো এমন হতে হবে, যা উভয়ের জন্য গ্রহণযোগ্য, বাস্তুচ্যুত জনগণের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি থাকতে হবে, করিডোরের আয় ও অবকাঠামো উন্নয়নে আর্মেনিয়ার অংশ নিশ্চিত করতে হবে এবং বহুপক্ষীয় সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এর সাথে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যে মানুষে-মানুষে সংযোগ বাড়াতে হবে, যাতে সমাজিক আস্থা গড়ে ওঠে।

দক্ষিণ ককেশাসে এর আগেও অনেক ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তি হয়েছে, কিন্তু অসমাধিত ক্ষোভ ও ক্ষমতার পালাবদলে তা ভেঙে পড়েছে। টিআরআইপিপি ব্যতিক্রম হতে পারে, তবে শর্ত একটাইÑ এটি হতে হবে সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে। অন্যথায়, ৯৯ বছরের এ করিডোর হতে পারে ভবিষ্যতের নতুন প্রতিযোগিতা ও সঙ্ঘাতের সূচনাবিন্দু, যেখানে আপাত শান্তি কেবল পরবর্তী ঝড়ের আগে সাময়িক বিরতি মাত্র।

লেখক-
মো: ওবায়দুল্লাহ :
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকার একজন ভিজিটিং স্কলার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপিতে পলিটিক্যাল সায়েন্সে উচ্চশিক্ষারত।

মেহেরাব হোসাইন : রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর গ্লোবাল মাইগ্রেশন স্টাডিস, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।