পাকবাহিনীর কাছে শেখ পরিবারের আত্মসমর্পণের প্রমাণ

লক্ষণীয়, শেখ জামাল বাসা থেকে বেরিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতেন এবং লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একজন বন্দীকে বাইরে অবাধে ঘোরাঘুরি করতে দেয়া হয় এমন কথা এর আগে কখনো শোনা যায়নি।

১৯৭১ সালে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করেছিল বলে দাবি করে আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে কেউ কেউ ভিন্নমত করেন। তারা বলেন, শেখ মুজিব যেমন বাসায় বসে থেকে পাকবাহিনীর কাছে ধরা দেন তেমনি তার পরিবারও আলাপ-আলোচনা করেই সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে যান।

তাদের বক্তব্যের প্রমাণ, মমিনুল হক খোকার লেখা বই। বইটির নাম ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও আমি’। প্রকাশক মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশ, প্রচ্ছদ এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী, মুখবন্ধ লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। ২০০০ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। মমিনুল হক খোকা নামটি তরুণদের কাছে পরিচিত নয়। তিনি শেখ মুজিবের মেজো ফুফুর কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি যে মুজিব পরিবারের কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তা জানা যায়, ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ বই থেকে। সিরাজুল আলম খানের তথ্যমতে, একাত্তর সালের ২৩ মার্চ দিবাগত রাতে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সাথে শেখ মুজিবের বৈঠকে নিউক্লিয়াস সদস্য সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ মনি, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও শেখ শহীদ ছাড়াও আরো দুজন উপস্থিত ছিলেন। তাদের একজন বেগম মুজিব এবং অপরজন মমিনুল হক খোকা।

সিরাজুল আলম খান ওই বইয়ে আরো জানান, ২৪ মার্চ দুপুরে শেখ মুজিবের সাথে তার দেখা হয়। শেখ মুজিব তাকে বলেন, ইয়াহিয়া খান আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আগামীকাল রাতেই ওরা আক্রমণ করবে। প্রথম পর্যায়েই প্রতিরোধটা যেন শক্ত হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, কাউকে বলিস না। আমি বাসাতেই থাকব।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে শেখ মুজিবের আত্মসমর্পণের বিষয়ে আরেকটি বিবরণ পাওয়া যায়। তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘২৩ মার্চে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে, মুজিব কাকুর বাড়িতে ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করল। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করলেন। আলোচনার আবরণে অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যার নীলনকশা তখন সম্পন্ন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাতে আব্বু গেলেন মুজিব কাকুকে নিতে। মুজিব কাকু আব্বুর সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। আত্মগোপনের জন্য পুরান ঢাকায় একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল। আব্বুর বিশ্বাস ছিল, ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে মুজিব কাকু কথা রাখবেন। অথচ শেষ মুহূর্তে মুজিব কাকু অনড় রয়ে গেলেন। তিনি আব্বুকে বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশু দিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি।’ মুজিব কাকুর তাৎক্ষণিক এই উক্তিতে আব্বু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এদিকে বেগম মুজিব ওই শোবার ঘরেই স্যুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন। ঢোলা পায়জামায় ফিতা ভরলেন। পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দী হওয়ার এসব প্রস্তুতি দেখার পরও আব্বু হাল না ছেড়ে প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু মুজিব কাকু তার এই সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে রইলেন।’

শেখ মুজিব কেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে নিশ্চিন্তভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তার কারণ ইয়াহিয়া খানের একসময়কার উপদেষ্টা জি ডাব্লিউ চৌধুরী তার ‘Last Days of United Pakistan’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষ্যমতে, ২৫ মার্চের আগেই মার্কিন কর্মকর্তাদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে শেখ মুজিবের একটি গোপন সমঝোতা হয় এবং তাতে শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

এবার দেখা যাক শেখ পরিবার কিভাবে পাকবাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে আশ্রয় নেয়।

মমিনুল হক খোকা লিখেছেন :

দুয়েক দিন পরেই ভাবী অস্থির হয়ে উঠলেন কামালের জন্য। ‘ভাইডি, কামালের একটু খোঁজ নে, একবার মানিক ভাইর বাসায় গিয়ে খোঁজ নে, ওরা জানলেও জানতে পারে।’ কী আর করব, যাত্রা করলাম মরহুম মানিক ভাইর বাসার উদ্দেশে।’

ভাবী (মরহুম মানিক মিঞার স্ত্রী) তখন থাকতেন ধানমন্ডিতে। পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জু থাকতেন সপরিবারে তার সাথে। আমাকে দেখে তো সবাই বিস্মিত। ভাবী আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন। আমি তার অপরিচিত নই। শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচি থেকে ঢাকায় এলে মানিক ভাইর কাছেই উঠতেন। মিঞাভাইর বার্তা নিয়ে আমাকে যেতে হতো তখন প্রায়ই। সে সময় থেকেই এ পরিবারের সব সদস্যের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা। ভাবী কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলেন, ‘মঞ্জুকে নিয়ে গিয়েছিল একদিন সেনাবাহিনী। আল্লাহ ওকে আবার ফেরত দিয়েছেন। এখনো আমাদের তোদের কথা জিজ্ঞাসা করতে প্রায়ই আসে। এ কথাও বলেছে, তোরা আত্মগোপন করে থাকলেও বের করে ফেলবে। তখন সাধারণ সৈনিকরা বাসাই উড়িয়ে দেবে; বরং তোরা নিজেরা এসে আত্মসমর্পণ করলে তারা তোদের নিরাপত্তার ভার নেবে। খোকা তুই গিয়ে ভাবীকে বুঝিয়ে বল।’

...আমার বাসায় পৌঁছার কিছুক্ষণ পর দেখি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আর তার মা এসে উপস্থিত। আমি বললাম, ‘ভাবীকে বুঝিয়ে বলুন আপনারা সব কথা, যা আমাকে কিছুক্ষণ আগে বলেছেন।’ মঞ্জু ও তার আম্মা ভাবীকে বললেন সব কিছু, সেই সাথে যোগ করলেন, ‘খোকা ভাইকে বলুন ওদের সাথে দেখা করতে।’ আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘না, না আমি ক্যান্টনমেন্ট যাব না।’ মঞ্জু বলল, ‘ক্যান্টনমেন্ট যেতে হবে না, ওরা তো আসে প্রায় প্রতিদিন, আমি আপনাকে খবর দেব যথাসময়ে।’

...একদিন মঞ্জুর বাসা থেকে সমন এলো। আমি আল্লøাহর নাম স্মরণ করে মঞ্জুর বাসাতে পৌঁছে দেখি সেখানে জেনারেল ওমর বসে আছেন। জেনারেল ওমর বোধ হয় তখন পাকিস্তানের আইএসআইয়ের প্রধান। সৌজন্য বিনিময়ের পর জেনারেল ওমর সরাসরি মূল বিষয়ে চলে আসেন। নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়ে দু’টি সম্ভাব্য স্থানের কথা উল্লেখ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কোন বড় শহর বা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কোন বাসা। আমি ভাবীর সাথে আলোচনা না করেই দুটো প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলাম। জেনারেল ওমর তখন বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের পছন্দসই কোনো বাড়ি দেখিয়ে দিন, কিন্তু আমাদের প্রহরাধীনে থাকতে হবে। তা আপনারা কি কোন বাড়ি দেখেছেন?’

‘না, আমরা কোনো বাড়ি দেখিনি’ আমি বললাম। ঠিক আছে, চলুন আমার সাথে কোন এলাকা আপনার পছন্দ সেখানেই যাব।’ আমি ধানমন্ডি এলাকাতেই বাড়ি খুঁজতে বেরুলাম জেনারেল ওমরের সাথে। অনেকগুলো বাড়ি দেখার পর ১৮ নম্বর সড়কে একটি বাড়ি পছন্দ হলো। বাড়িটি একতলা, উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালে ঘেরা, পেছনে বেশ জায়গা, সামনে সুন্দর গেট। জেনারেল ওমর বললেন, ‘কোই বাত নেই, হাম লে লেতে ইয়ে মাকান, তোম আভি যাকে তোমহারা ভাবী-কো লে আও।’ আমাকে ধানমন্ডিতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে গেল।

একরাশ দুর্ভাবনা নিয়ে বাসাতে ফিরে এলাম। ভাবীকে সব বললাম। ভাবীর প্রথম মন্তব্য হলো, ‘তা হলে তো আমাদের এখানকার আস্তানা গুটিয়ে পালাতে হয়।’ আমি বললাম, ‘আর কোথায় পালিয়ে যাব। তাছাড়া ওরা যখন টের পেয়েছে, পরে আমাদের ধরতে পারলে অবস্থা আরো খারাপ হবে।’ ভাবী বললেন, ‘আমি একবার মঞ্জুর বাসাতে যাব, কিন্তু তার আগে তুই মইনুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে দেখা করে আয়।’ মইনুল ইসলাম মামু তখন থাকতেন শান্তিনগরে। তার বাসাতে গিয়ে তাকে সব কিছু খুলে বললাম। মামু আঁতকে উঠলেন, ‘সর্বনাশ, আর তো কোনো উপায় নেই।’ মামুর কাছ থেকে ফিরে সেদিনই ভাবীকে নিয়ে মঞ্জুদের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি জেনারেল ওমর বসে আছেন। ভাবীকে দেখে যথারীতি সম্মান দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কি তক্ষুণি ১৮ নম্বর বাসাতে উঠছি কি না। ভাবী আমাকে বলতে বলল যে, আমরা সেই রাতে ৩২ নম্বর থেকে প্রায় এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছি। তাই আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে ৩২ নম্বর বাসাতে যেতে হবে। জেনারেল ওমর বললেন, ‘ঠিক হ্যায়, মগর জলদি করনা।’ জেনারেল ওমরের গাড়ির সাথে সাথে আমার গাড়িতে আমি আর ভাবী ৩২ নম্বরে এসে পৌঁছলাম।

...হাসিনা, ভাবী সবাই মিলে আলোচনা করলাম। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে যখন একই কথা আবার বলছি সবাই, হঠাৎ দেখি দুটো জিপ ভর্তি পাক সেনাদল এসে বাসার চারপাশে পজিশন নিলো। তাদের কমান্ডার, বোধ হয় মেজর র‌্যাংকের একজন কর্মকর্তা, এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। কে কে থাকে এখানে, শেখ মুজিবের স্ত্রী কোথায়, তাকে আসতে বলুন। ভাবী, হাসিনা সবাই এলো। ওয়াজেদ ছিল কি না, এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না।

মেজর বলতে শুরু করল, ‘এভাবে থাকা আপনাদের পক্ষে নিরাপদ নয়, যেকোনো সময়ে দুষ্কৃতকারীরা আপনাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। তাই আমরা অন্যত্র আপনাদের থাকার জায়গা ঠিক করেছি। এক্ষুণি আপনাদের আমার সাথে যেতে হবে।’ আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই, মেজরের নির্দেশ মানতে হলো। প্রায় সেই অবস্থাতেই সবাইকে নিয়ে আমার গাড়িতে উঠি। আগে-পিছে সামরিক বাহিনীর জিপ, এক সময়ে এসে থামি ধানমন্ডি এলাকার ১৮ নম্বর সড়কের সেই বাড়ির সামনে, যেটি আমি জেনারেল ওমরকে দেখিয়েছিলাম। আমরা এ বাসাতে প্রবেশের সাথে সাথে বাসায় মিলিটারি চৌকি বসে গেল।’

শেখ হাসিনার স্বামী ডা: এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইয়ে শেখ মুজিব পরিবারের গ্র্রেফতার হওয়ার বর্ণনা দিলেও ওই বইয়েই তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি পারমাণবিক শক্তি কমিশনে চাকরি করতে যেতেন। শেখ হাসিনা সন্তানসম্ভাবা হওয়ার কারণে তাকে চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে যেতেন। মমিনুল হক খোকাও তার সন্তানদের নিয়মিত স্কুলে নিয়ে যেতেন। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের কোথাও এমন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় কি?

শেখ জামালের বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টিও প্রমাণ করে, মুজিব পরিবারকে আটক নয় বরং নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছিল। মমিনুল হক খোকা লিখেন : ‘এমন সময়ে ঘটল জামালের বিস্ময়কর অন্তর্ধান। ঘটনাটি আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ঘটল। সকালবেলা আমি আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলছি, হঠাৎ শুনি জামালকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল কেউ কোনো কিছু বলতে পারছে না। সন্দেহ হলো পাকিস্তানিরাই কি ওকে তুলে নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে?

পাহারাদারদের জিজ্ঞাসা করতেই তারা বেজায় খাপ্পা। আমাদের ৩২ নম্বরের বাসার সামনে একটি পান-সিগারেটের দোকান ছিল। জামাল মাঝে মধ্যে যেত সেখানে। ওখানে তখন কাজ করত আমাদের আগের কাজের লোক রহমান ও আবদুল। দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ওখানে পেলাম রহমানকে। সে জানাল, জামাল মাঝে মধ্যে এসে ওদের সাথে আলাপ-আলোচনা করত। তার নাকি আজকালের মধ্যেই পালিয়ে ভারত যাওয়ার কথা ছিল। সে জানায়, জামাল সীমান্ত পাড়ি দেয়ার উদ্দেশে একটা ছেলেকে নিয়ে এখান থেকে চলে যায়।

লক্ষণীয়, শেখ জামাল বাসা থেকে বেরিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতেন এবং লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একজন বন্দীকে বাইরে অবাধে ঘোরাঘুরি করতে দেয়া হয় এমন কথা এর আগে কখনো শোনা যায়নি।