আবুল কালাম মানিক
দেশের একটি বহুল আলোচিত দৈনিকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিল্লিতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিবালয় স্থাপনের খবরে অভিজ্ঞ মহলে বেশ উদ্বেগ, চাঞ্চল্য ও শোরগোল শুরু হয়েছে। রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে চলছে তোলপাড়। এটি শুরু হয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে সত্য প্রকাশে ভারতের স্বভাবসুলভ অস্বীকারের নীতিকে উপেক্ষা করেই। নয়াদিল্লি অবশ্য দাবি করেছে, বিষয়টি তাদের জানা নেই। তবে বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত গণহত্যার দায়ে বিচারের সম্মুখীন পলাতক প্রধানমন্ত্রীর জন্য দিল্লির এই বিশেষ আয়োজনে ঢাকার সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত ও হতচকিত। তাদের বিবেচনায় ঘটনাটি বজ্রপাততুল্য হলেও ভারতের পক্ষে এটি স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ বটে। সরকারিভাবে অস্বীকার করলেও এর মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার কথা রেখেছেন। বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। এমনও নয় যে, ভারত আকস্মিক হাসিনা-আওয়ামী লীগের স্বার্থে নজিরবিহীন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে। দিল্লির প্রত্যক্ষ সহযোগিতাতেই কাদেরিয়া বাহিনী-শান্তি বাহিনীর বাংলাদেশবিরোধী সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা অনেকেরই মনে আছে।
বাংলাদেশের জন্য অশনি সঙ্কেততুল্য দিল্লির এই উদ্যোগকে কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ এমনকি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল দাবি করলেও মোদি শেখ হাসিনাকে মোটেও হতাশ করেননি, উত্তম প্রতিদানই দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ-ভারত স্বার্থের সমীকরণে এমনটিই হওয়ার কথা ছিল, তাই হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মর্মবেদনার কারণ ঘটলেও মোদি তার নীতি ও আদর্শের সাথে বিন্দুমাত্র আপস করেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিশ্রুত একাত্তরের চেতনা সমুন্নত রাখতেই দিল্লিতে হাসিনার দলীয় কার্যালয় খুলে দিয়েছেন। অতীতের ধারাবাহিকতায় সামনের দিনগুলোতে আরো অনেক কিছুই করবেন। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, মোদি-হাসিনার একাত্তরের চেতনার এটিই ঘোষিত অঙ্গীকার।
আসন্ন এ হুমকি মোকাবেলায় ঢাকার আদৌ কোনো কার্যকর কর্মপরিকল্পনা আছে কি না তাতে সন্দেহ পোষণের অনেক কারণ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ এমনকি মিডিয়া এ ব্যাপারে দিল্লির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে এমন আশা করা যায় না মোটেই। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্র তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। দেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী সফল গণ-অভ্যুত্থান এবং ইউনূস সরকারের ক্ষমতারোহণের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের পারদ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে ভারতের সরকার ও মিডিয়া পাগলপ্রায়। তাদের নিত্যদিনের মিথ্যাচার ও অপপ্রচার অব্যাহত রয়েছে। সফল গণ-অভ্যুত্থানকে সশস্ত্র সন্ত্রাস, চরমপন্থা এমনকি ইসলামী মৌলবাদের তকমা পরিয়ে কালিমালিপ্ত করার অপপ্রয়াস পুরোদমে চলছে। এহেন পরিস্থিতিতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশ্লেষক, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ ও উৎসুক জনতা যে ধারণাই পোষণ করেন না কেন, ভারত হাসিনা ও আওয়ামী লীগের স্বার্থকে সবার ওপর স্থান দেবে- এটিই বাস্তবতা। নিকট অতীতের ইতিহাসও তারই সাক্ষ্য দেয়।
বাংলাদেশের বর্তমান ও আগামী নেতৃত্বের কাছে গৌণ বিবেচিত হলেও দিল্লি প্রকাশ্যে এমন প্রত্যয় বেশ আগেই ঘোষণা করেছে। অভিন্ন চেতনা ও লক্ষ্যের রাখিবন্ধনে আওয়ামী লীগ-ভারত অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে একত্রে লড়বে হাসিনাকে এই আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। ভুলে গেলে চলবে না, অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে একাত্তরের চেতনার ধারক, বাহক ও রক্ষক নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং এই যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয়ভাবে। ভারতে হাসিনার নিরাপদ আশ্রয় এবং দিল্লিতে দলীয় কার্যালয় খুলে দেয়া সেই যুদ্ধেরই অনুষঙ্গ। হাসিনাকে যারা ক্ষমতাচ্যুত করে ভারতের স্বার্থহানি ঘটিয়েছে মোদি তাদের ছেড়ে দেবেন- এমন কল্পনা করা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। হীনস্বার্থে মোহগ্রস্ত তথাকথিত ফ্যাসিবাদবিরোধী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান হিংসা হানাহানির সুযোগ নিয়ে ভারত সামনের দিনগুলোতে অনায়াসে এমন আরো ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নেবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আওয়ামী লীগ বিশেষ করে দলটির বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা ও ভারত অভিন্ন চেতনা ও স্বার্থের অভিযাত্রী। ভারতের নীতিনির্ধারকরা আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের উত্তম বিকল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। তারা আওয়ামী লীগ নেই এমন বাংলাদেশ কল্পনাও করতে পারে না। দিল্লির প্রতি সীমাহীন নিঃশর্ত আনুগত্যের কারণে ভারত হাসিনাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই অনন্য মর্যাদা হাসিনার প্রতি দিল্লির বিশেষ অনুদান কিংবা করুণা নয়, বরঞ্চ ন্যায্য প্রাপ্য। এ ন্যায্য প্রাপ্যতার স্বীকৃতি মেলে স্বয়ং শেখ হাসিনার বক্তব্যে। হাসিনা ২০১৮ সালে ভারত সফর শেষে ঢাকায় ফিরে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রতিদিনের বোমাবাজি-গুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটি তাদের মনে রাখতে হবে।’ তারই যথাযথ প্রতিদান হিসেবে ভারত দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন, রীতিনীতি, বিধান ও কূটনীতি লঙ্ঘন করে দিল্লিতে হাসিনার সচিবালয় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনুরূপভাবে হাসিনার অনন্য অবদানের স্বীকৃতি দিতে মোটেও কার্পণ্য করেননি মোদি। বিগত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরকালে মোদি প্রকাশ্য ঘোষণায় বলেছিলেন, ‘আজ আমরা সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ দমনে সহযোগিতায় জোর দিয়েছি। ১৯৭১ সালের চেতনা বাঁচিয়ে রাখতে হলে যে শক্তিগুলো আমাদের পারস্পরিক আস্থায় আঘাত করে তাদের বিরুদ্ধে এক সাথে লড়াই করা গুরুত্বপূর্ণ।’ সেই পারস্পরিক আস্থা বিনষ্টকারী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে ভারতের মাটিতে হাসিনার সচিবালয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশে মোদির ১৯৭১ সালের চেতনাবিরোধী শক্তির হাতে হাসিনার পরাজয় ও পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া কোনো দিনও সহজভাবে নেবে না নয়াদিল্লি। দিল্লিতে পতিত আওয়ামী লীগকে সচিবালয় স্থাপনের সুযোগ করে দিয়ে মোদি ঢাকাকে সেই বার্তাই দিয়েছেন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ মোদির ভাষায় একাত্তরের এবং হাসিনার বয়ানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই করে তাদের অভিন্ন চেতনায় আঘাত করেছে। মোদি-হাসিনার পারস্পরিক আস্থা বিনষ্ট করে তাঁবেদার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। ঢাকায় একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এই সরকার ভারতের একক স্বার্থবিরোধী স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। এতে সঙ্গতকারণেই নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিশেষ করে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ। তাদের পরাভ‚ত করে হাসিনাকে হারানো সিংহাসন ফিরিয়ে দেয়াই মোদির একান্ত পণ।
দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ পাঁচ দশকের দেন-দরবার ও দরকষাকষি থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এমন সিদ্ধান্ত ও ঐকমত্যে উপনীত হয়েছে, ঢাকার কাছে দিল্লির প্রত্যাশাগুলোর ধরন হলো এক ধরনের আবদার, অন্য দিকে দিল্লির কাছে ঢাকার দাবিগুলো হলো বৈধ অধিকার। দিল্লি ঢাকার বৈধ অধিকার কখনোই স্বীকার করেনি, নিকট ভবিষ্যতে করবে এমন আশা করাও বাতুলতামাত্র। বিশেষ করে ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে ভারতপন্থী স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং দলবল নিয়ে হাসিনার ভারতে পলায়নের পর নয়াদিল্লির বাংলাদেশবিদ্বেষী তৎপরতা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মোদি বাংলাদেশের মানুষকে শাস্তি দেয়ার জন্য এক বিশদ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে হাসিনাকে সহায়তা করতে দিল্লিতে হাসিনার দলীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মানুষের মূল আকাক্সক্ষাই ছিল একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ভারত এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাকে একবারেই হতাশ করে দিয়েছে। এটি ঐতিহসিক সত্য যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কার্যত মুক্তিযুদ্ধে রূপ লাভ করলে ভারত সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ভারতের এই ভ‚মিকা মুক্তিপাগল বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয়ও করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের কার্যকলাপ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে, একাত্তরে দিল্লির অবস্থান ছিল নিজস্ব সামরিক কৌশলগত- কোনোক্রমেই গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের অনুকূলে নয়। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী চরিত্র ও রাজনৈতিক হঠকারিতায় বিগত ৫০ বছরেও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ভারত আওয়ামী লীগের একদলীয় নিপীড়নমূলক শাসন পদ্ধতিকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে বিপক্ষে কাজ করেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটাধিকার হরণ ও নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে দেশে স্বৈরশাসন কায়েম করেছে। অবৈধ ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে নির্বিচার লুটপাট, গণনিপীড়ন, গুম, খুন এমনকি গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেও ভারতের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ভোগ করেছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গত প্রত্যাশা ছিল, ভারত এই সঙ্কটে আওয়ামী লীগের পরিবর্তে নিপীড়িত মানবতার পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটাই। মোদির কণ্ঠে ঘোষিত আওয়ামী লীগ-ভারত একাত্তরের চেতনা বাংলাদেশের মানুষের জন্য বারবার মরণফাঁদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশে গুম, খুন, হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের জন্য নয়াদিল্লিতে রাজনৈতিক কার্যালয় খুলে দেয়া সেই চেতনা বাস্তবায়নেরই একটি সামান্য উদাহরণ মাত্র।