ইসরাইলের পতন শুরু!

শুরু থেকে ব্রিটেন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরাইল সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে এমন সব ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আসছে, যা মানব ইতিহাসে খুব কম ঘটেছে। সম্ভবত এখন সে অপরাধের দায় শোধের পালা এসে গেছে। কারণ আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে কখনো পছন্দ করেন না।

ঘটনাপ্রবাহের সামগ্রিক বিবেচনায় এটি বলা যায়, পশ্চিমাদের সৃষ্ট কৃত্রিম রাষ্ট্রটির পতন হওয়া শুরু হয়েছে। আমি ইসরাইলের কথা বলছি, যাকে রাষ্ট্র না বলে একটি গ্যারিসন বলাই উত্তম। মূলত ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যের পেটের মধ্যে এরকম একটি গ্যারিসন রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রথম উদ্যোক্তা, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করা।

নিঃসন্দেহে দেশটি ১৯৪৮ সালে গঠন হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যে শক্তিমত্তা ও কর্তৃত্ব দেখিয়ে আসছে তা নজিরবিহীন বটে। অর্থাৎ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা যাকে চ্যালেঞ্জ করতে আশপাশের কোনো মুসলিম দেশ এতদিন সাহস করে ওঠেনি। কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলেছে। প্রথম ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া ইসরাইলকে চ্যালেঞ্জ করে যুদ্ধ সূচনা করে। যে ইসরাইল ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে সিরিয়া, জর্দান ও মিসরের বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছিল, সেই দেশটি ২০০৬ সালে হিজবুল্লার বিরুদ্ধে ৩৪ দিন যুদ্ধ করে অবশেষে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ আসে ২০২৩ সালে হামাস প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছ থেকে। তারা ওই বছর ৭ অক্টোবর প্রযুক্তিগত সব ধরনের উৎকর্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে শতাধিক নাগরিককে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তারপর ইসরাইল হামাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তা এখন গড়িয়েছে ২১ মাসে।

সর্বশেষ অপরাজয়ের ধারণায় বেপরোয়া ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে এখন ভয়াবহ প্রতিশোধমূলক প্রত্যাঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইরানের শক্তিমত্তাকে অবজ্ঞা করে ইসরাইল নিজে এ বিপদ ডেকে এনেছে। গত ১৩ জুন কোনো উসকানি ছাড়া ইসরাইল প্রথম এ আক্রমণ চালায়। ইসরাইলের সামরিক নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, যেভাবে তারা ১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করেছিল কিংবা যেভাবে তারা ২০০৭ সালে সিরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনা বিধ্বস্ত করে ওই দু’টি দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে আক্রমণ চালিয়ে ইরানকে নিস্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো। কারণ ইরানের প্রত্যাঘাতে তাদের বহু বছর ধরে সাজানো নিñিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থায় ভেঙে পড়েছে।

ইরানের এ বিধ্বংসী হামলা ইসরাইলের জনগণের মন থেকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নিরাপত্তা বেষ্টনীর অহঙ্কার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। আজ তারা প্রাণ ভয় পালাচ্ছে। পাড়ি জমাচ্ছে অন্য দেশে। এ ছাড়া বেশ কিছু বছর ধরে ইসরাইলে একক কোনো দলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। কারণ বিগত কয়েকটি নির্বাচনে একক কোনো দল সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। সুতরাং বারবার কোয়ালিশন সরকার দেশ চালাচ্ছে। আর এটি হচ্ছে ইসরাইল সমাজের বিভাজনের ফল। মাঝখানে কিছু সময় ছাড়া বেশ অনেক বছর ধরে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে একটি চরম উগ্রবাদী জোট সরকার ইসরাইল শাসন করছে।

ঠিক এরকম পটভূমিতে ইসরাইলের জনগণ বেশ কয়েক বছর ধরে এ উগ্রবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। বিশেষ করে গত বছর সংবিধান সংশোধন করে বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে। তাই অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ইসরাইলের উগ্রবাদী সরকার যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে; যা কার্যত বিপদ আরো তীব্র করেছে। কারণ মরুভূমির শুষ্ক অঞ্চলে ইউরোপীয় ধাঁচে জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে যারা বিভিন্ন দেশ থেকে ইসরাইলে এসে যে নিরাপদ আবাস গড়ে তুলেছিল তা এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এখন তারা দলে দলে ইসরাইল ছেড়ে ইউরোপে বা অন্য কোনো নিরাপদ দেশে যাওয়া শুরু করবে। এটি হচ্ছে ইসলাইলের পতনের সূচনা। অর্থাৎ ইসরাইলিদের আস্থার জায়গা ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে দেশটির পতন শুরু হয়ে যাওয়া।

একটি কথা সবার মনে রাখা উচিত- অতীতে সব সভ্যতা ও বেপরোয়া অনৈতিক শাসনের ধ্বংস হয়েছে মূলত অ্যারোগেন্সি বা ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারের কারণে। ইসরাইল এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। যে ব্রিটিশ শাসকরা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোক্তা তারা কি কখনো জানত এক দিন তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের অহঙ্কার গুঁড়িয়ে যাবে। এ ব্যাপারে একটু অতীতের দিকে ফিরে গেলে আমরা দেখতে পাবো, ইসরাইল রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন কিভাবে ঘটেছিল এবং এখন তার পরিণতি কোন দিকে।

এটি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৭ সালের কথা। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদিদের জন্য একটি আবাসস্থল গঠনে একটি প্রস্তাব আনেন যাকে বলা হয় ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইহুদিদের সমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশরা। ওই প্রস্তাব তখন আনা হয় যখন প্রথম যুদ্ধের শেষ দিকে ব্রিটেন অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন মুক্ত করে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করে। মূলত এটি ছিল ব্রিটেনের বিখ্যাত এক ইহুদি নাগরিক ব্যারন লায়নেল ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে প্রদত্ত ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোরের একটি চিঠি, যা পরবর্তীতে ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ওই চিঠিতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য পৃথক একটি আবাসস্থল তৈরির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ব্রিটেনের এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে চরম উগ্রবাদী জায়নবাদী একটি সংগঠন সৃষ্টি হয় এবং শেষতক ১৯৪৮ সালে ১৪ মে ইসরাইল নামে জায়নবাদীদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

শুরু থেকে ব্রিটেন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরাইল সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে এমন সব ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আসছে, যা মানব ইতিহাসে খুব কম ঘটেছে। সম্ভবত এখন সে অপরাধের দায় শোধের পালা এসে গেছে। কারণ আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে কখনো পছন্দ করেন না।