শহীদ আবু সাঈদ : স্বপ্ন, বিদ্রোহ ও আত্মত্যাগের গল্প

‘সাঈদ বরাবরই প্রতিবাদী ছিল, তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হবে। যদি ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতি চালু থাকে তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যাডার হওয়ার পথ অনেকটা দুর্গম হয়ে উঠবে।’

শহীদ আবু সাঈদ
শহীদ আবু সাঈদ |নয়া দিগন্ত

ইমরান আকন্দ

বাংলাদেশের ইতিহাসে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। যা ছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক দুর্দান্ত সামাজিক বিস্ফোরণ। এই অভ্যুত্থানে যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, শহীদ আবু সাঈদ তাদের অন্যতম। ১৬ জুলাই তার মৃত্যুই সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মোড় ঘুরে রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে। চব্বিশের গণ আন্দোলনে শিশু থেকে শুরু করে তরুণ ছাত্র, শ্রমিক ও অসংখ্য সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছেন। তবে আবু সাঈদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে রচিত হয় গণঅভ্যুত্থানের ভীত। ইতিহাস যখন ন্যায়বিচারের পথ খুঁজে পায় না, তখন কিছু মানুষ সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হয়ে ওঠে আলোর দিশারী। শহীদ আবু সাঈদ তেমনি এক দুর্মর তরুণ। যার জীবন ছিল স্বপ্নময়, মন ছিল বিদ্রোহী আর যার মৃত্যু-এক অনন্ত আত্মত্যাগের মহাকাব্য।

রংপুরের হতদরিদ্র কৃষক দম্পতি মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগমের ঘরে জন্ম নেয়া আবু সাঈদ ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ তরুণ। তিনি বরাবরই চাইতেন একটি শোষণমুক্ত, ন্যায় ভিত্তিক সমাজ যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। মেধাবী এই তরুণ কখনো অন্যায়ের আপোষ করেননি। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন অন্যায়ের পক্ষে থেকে শত বছর বাঁচার চেয়ে ন্যায়ের পক্ষে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা অধিক উত্তম ও সম্মানের। শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয় তার ফেসবুক পোস্টগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় তিনি সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ন্যায়ের পক্ষে সরব থেকেছেন অনলাইন মাধ্যমেও। তাছাড়া ২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম থেকেই প্রতিবাদী চরিত্রে ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে তার সহপাঠী রিপন মিয়া বলেন, ‘সাঈদ বরাবরই প্রতিবাদী ছিল, তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হবে। যদি ৫৬% কোটা পদ্ধতি চালু থাকে তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যাডার হওয়ার পথ অনেকটা দুর্গম হয়ে উঠবে। তাছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য,প্রশ্ন ফাঁস এসবের মধ্যদিয়ে পড়ালেখা শেষ করে ভালো চাকরি পেতে হবে এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই সাঈদ পুরোপুরি সক্রিয় ছিল।’

সাঈদের এই স্বপ্ন শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তা বিস্তৃত ছিল জাতির সার্বিক মুক্তির মধ্যে।

সোনার হরিণ সমতুল্য সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার পরিমাণ বেশি থাকায় চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে বরাবরই অসন্তোষ ছিল, ক্ষোভ ছিল।বহুদিনের সেই ক্ষোভ চব্বিশের জুলাই এ এসে রূপ নেয় বিক্ষোভে।

বলা যায় বাংলাদেশের ইতিহাস আন্দোলনের ইতিহাস। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মহান মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি মুক্তিযুদ্ধোত্ত্বর নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে ঘটে যাওয়া এক একটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন। সব আন্দোলন ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোরণ সৃষ্টি করে চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। যেখানে ছাত্ররা ছিল অগ্রণী শক্তি। আবু সাঈদ সেই ছাত্রদের একজন ছিলেন, যিনি রাজপথে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন, দুই হাত পাখির ডানার মত প্রসারিত করে বুক টান করে পুলিশের গুলিকে আলিঙ্গন করেছিলেন, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন-পরিবর্তন আনতে হলে প্রতিবাদ করতে হয়,বিদ্রোহ করতে হয়। তার এই অভিনব প্রতিবাদের ভঙ্গিমাই তাকে বিদ্রোহের প্রতীকে পরিণত করে।

১৬ জুলাই ২০২৪, কোটা সংস্কার আন্দোলন সারাদেশে আরো তীব্রতর হয়। শহিদ শামসুজ্জোহা স্যারের চেতনায় উদ্ভাসিত যুবক, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের ছাত্র আবু সাঈদ বীরের বেশে নেমে আসেন রংপুরের রাজপথে। পরনে কালো টি-শার্ট আর ধূসর রংয়ের ট্রাউজার, পায়ে স্নিকার্স, হাতে বাঁশের লাঠি। ‘মৃত্যু অথবা মুক্তি’ এমন পণ করেই হয়তো সেদিন আন্দোলনে এসেছিলেন তিনি। পুলিশি বাধার বিপরীতে আবু সাঈদ যেন ‘ঢাল নেই তরবারি নেই নিধিরাম সরদার’! কেবল বুক ভরা সাহস নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুরো রাস্তা চষে বেরিয়েছেন বীরের মুদ্রায়। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর শটগানের নিষ্ঠুর গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় সাঈদের বুক। শামসুর রাহমানের কবিতার লাইন ধরে বলতে চাই, ‘আবু সাঈদের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়’।

সেদিন তার এই সাহসী আত্মত্যাগ ছিল নাৎবাক রাজনীতির কপালে অগ্নি লিখন। তার রক্তেই যেন শপথ নিয়েছিল ছাত্র সমাজ তথা গোটা বাঙালি -আর না, এবার আমরা আমাদের অধিকার নিজেই গড়ে নেব।

আপামর জনতার বিদ্রোহী চেতনার সামনে অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হন দীর্ঘ ১৬ বছর বিরোধী শক্তিকে থুরায় কেয়ার করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হন। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় নতুন দিন ‘৩৬ জুলাই ’।

আবু সাঈদের স্বপ্ন, বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ নিছক তিনটি শব্দ নয় বরং এক নবজাগরণের আহ্বান। তার আত্মত্যাগের বদৌলতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত মুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত,বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের মাধ্যমে শহিদের রক্ত ও জীবনকে আমরা সম্মান জানাতে পারি। মনসুর আহমদের কথা দিয়ে শেষ করছি -

আমি রংপুরের আবু সাঈদ

আমার বুকের জমিন -

গণতন্ত্র আর মানচিত্রের চেয়েও সুদীর্ঘ।

রক্তে রঞ্জিত কালো টি-শার্টে

আমার অধিকারের কথা লিখা আছে।

লেখক: গবেষক ও প্রকৌশলী