মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক ও সামাজিক ব্যবসায়

প্রধান উপদেষ্টার এ চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের রূপ পরিবর্তন করে দিতে পারে যদি আমাদের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইন মানার মানসিকতা তৈরি হয়। তবে মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে নানা ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, যেগুলোয় ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই থাকতে পারে। মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রভাব নির্ভর করে এর পরিচালনা পদ্ধতি, ঋণের শর্তাবলি এবং ঋণগ্রহীতাদের সক্ষমতার ওপর। সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং থাকলে এটি সমাজে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। অন্য দিকে শিথিল নীতিমালা ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় এটি নেতিবাচক ফলাফল ডেকে আনতে পারে

মাইক্রো ক্রেডিট দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং প্রত্যন্ত গ্রামপর্যায়ে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে অর্থনৈতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশে ৫৩ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে মানুষের জীবনযাত্রায়। ১৯৭০ সালে দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মাথাপিছু জিডিপি ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দুই লাখ আট হাজার ৭৫১ টাকা থেকে বেড়ে দুই লাখ ৯৪ হাজার ১৯১ টাকায় উন্নীত হয়। দেশের উৎপাদন ও উপার্জন প্রক্রিয়ার বিকাশে শুধু সরকার নয়, সরকারের অংশীদার হিসেবে এনজিও-এমএফআই (ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান) খাত নিভৃতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছে। এ খাত স্বাধীনতা-পরবর্তী দরিদ্র ও হতদরিদ্র-অধ্যুষিত বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে দারিদ্র্যনিরসন ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে বেশি নজর দিয়েছে। শুধু দারিদ্র্যদূরীকরণ নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের টেকসই উন্নয়নে এনজিওগুলো অনেক দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে।

শত শত বছর ধরে অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র্যদূরীকরণে বিভিন্ন মডেল বা কৌশল নিয়ে কাজ করেছেন; কিন্তু কোনোটিই বাংলাদেশ উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণের মতো কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য বা স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি। ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল জয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্রঋণের বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য তুলে ধরে তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ জন্য তিনি ‘মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি’ আইন করার কথা বলেছেন। মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ও দেশের অর্থনীতিতে এর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, এই ব্যাংক প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর মতো হবে না। ব্যাংক চলবে বিশ্বাস ও আস্থার ওপর ভিত্তি করে। যেখানে ঋণ নিতে জামানত লাগবে না। এর পাশাপাশি এই ব্যাংকের বড় উদ্দেশ্য হবে সামাজিক ব্যবসায়কে ছড়িয়ে দেয়া।

মানুষ মাত্রই উদ্যোক্তা। আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার সরঞ্জাম তার হাতে তুলে দেবো।

বিনিয়োগের টাকা পেলে মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা নিজের বুদ্ধি দিয়ে ব্যবসায় চালু করতে পারবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস আরো বলেন, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীরা কেউ টাকা মেরে চলে যায়নি। অথচ প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক হাওয়া হয়ে গেছে। ব্যাংকের টাকা নিয়ে অনেকে উধাও হয়েছে। তাই আমাদের এখন প্রকৃত ব্যাংকের দিকে নজর দিতে হবে।

তিনি বলেন, সেটিই প্রকৃত ব্যাংক যার ওপর মানুষ বিশ্বাস রাখে, আস্থা রাখে যেমন ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’। অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এমআরএ কেবল বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের জন্য নয়; বরং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্যও ভালো কাজ করছে। এ ক্ষুদ্রঋণের সাথে সামাজিক ব্যবসার এক সংযোগের কথা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তুলে ধরেন। তরুণদের মধ্যে সামাজিক ব্যবসার ধারণা দিতে হবে। সামাজিক ব্যবসায় কী, এর কাজ ও ক্ষেত্র কী এ সম্পর্কে জানা দরকার। যতদূর আমারা জানতে পেরেছি, সামাজিক ব্যবসায় হলো এমন একটি ব্যবসায়িক মডেল, যার প্রধান লক্ষ্য সামাজিক সমস্যা সমাধান করা, মুনাফা অর্জন নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ধারণাটি প্রবর্তন করেন এবং বিশ্বজুড়ে এর প্রচার করেন। সামাজিক ব্যবসার মূল নীতি হলো সমাজের একটি নির্দিষ্ট সমস্যা (যেমন দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ) সমাধান করা।

এ ব্যবসায়টি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী; কিন্তু শেয়ারহোল্ডার বা বিনিয়োগকারীদের মুনাফা বিতরণ করা হয় না। লাভ পুনরায় ব্যবসায় বা সামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হয়। এটি দাতব্য প্রকল্প নয়; বরং একটি টেকসই ব্যবসায়িক মডেল, যা নিজেই আয় জেনারেট করে। সামাজিক ব্যবসায় প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দেয়।

সামাজিক ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা

এটি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং তাদের আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বাণিজ্যিক ব্যবসায়গুলো যেসব সমস্যা এড়িয়ে যায় (যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিচ্ছন্নতা), সামাজিক ব্যবসায় সেগুলোকে টেকসইভাবে সমাধান করে।

এটি জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন (ঝউএং) অর্জনে ভূমিকা রাখে, যেমন ক্ষুধা নির্মূল, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি। প্রচলিত ব্যবসায় মুনাফাই প্রধান লক্ষ্য; কিন্তু সামাজিক ব্যবসায় মানুষের কল্যাণ মুখ্য। এটি সম্পদ ও সুযোগের অসমতা কমাতে সাহায্য করে, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য। অনেক সামাজিক ব্যবসায় পরিবেশবান্ধব পণ্য ও পরিষেবা নিয়ে কাজ করে, যেমন নবায়নযোগ্য শক্তি বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

ড. ইউনূসের মতে, ‘সামাজিক ব্যবসায় পুঁজিবাদের একটি উন্নত রূপ, যেখানে মানবকল্যাণ অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকে।’ এটি বিশেষভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা সামাজিক ব্যবসায়কে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবে এ আশা ব্যক্ত করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব দূরীকরণে মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক ও সামাজিক ব্যবসার থিওরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

তিনি বলেন, মাইক্রো ক্রেডিট নিয়ে আমরা এমন পর্যায়ে এসেছি, এ নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক নামে একটি আইন করতে হবে। এটি নতুন একটি ব্যাংক হতে হবে।

তিনি আরো বলেন, তারা সদস্যদের সঞ্চয় নিতে পারে, বাইরের কারো ডিপোজিট নিতে পারে না। এটি তাদের সীমাবদ্ধতা। এর কারণে তার অন্যের কাছে হাত পাততে হয়, দায়বদ্ধ হতে হয়, কেন হবে? সে এত সুন্দর ব্যাংকিং করে, আরেক জনের কাছে হাত পেতে কেন করবে? তার মধ্যে কি অভাব আছে? যেটি সমবায় ব্যাংকের ছিল। সমবায় ব্যাংককে আপনারা ব্যাংক বলছেন, মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংককে আপনারা ব্যাংক বলবেন না? তাকে সেই অধিকার দেবেন না, কী কী পাস করতে হবে তাকে এটি করার জন্য? সে তো সব কিছু পাস করে এসেছে। কাজেই আমার মনে হয় সময় এসেছে, মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক আইন করার।

তিনি বলেন, আমরা যখন মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংকের জন্য লাইসেন্স দেবো তখন পরিষ্কার বলতে হবে যে, এই কাজের জন্য আপনাকে ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো হবে সামাজিক বাণিজ্যের ব্যাংক, সামাজিক ব্যবসার ব্যাংক। আইনের মধ্যেই থাকবে যে, এটি হচ্ছে সামাজিক বাণিজ্যিক ব্যাংক। প্রধান উপদেষ্টার এ চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের রূপ পরিবর্তন করে দিতে পারে যদি আমাদের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইন মানার মানসিকতা তৈরি হয়। তবে মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে নানা ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, যেগুলোয় ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই থাকতে পারে। মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রভাব নির্ভর করে এর পরিচালনা পদ্ধতি, ঋণের শর্তাবলি এবং ঋণগ্রহীতাদের সক্ষমতার ওপর। সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং থাকলে এটি সমাজে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। অন্য দিকে শিথিল নীতিমালা ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় এটি নেতিবাচক ফলাফল ডেকে আনতে পারে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ই-মেইল :
[email protected]