যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে এখন শান্তির বাহক বলে পরিচয় দিচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও তিনি শান্তির কথা বলেছেন। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দাবি করেছেন, ভারত-পাকিস্তান এবং ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ তারই প্রচেষ্টার ফল। ট্রা¤প আক্ষেপ করে বলেছেন, পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ তিনি থামিয়েছেন, তার পরও নোবেল পাননি। তিনি একাই ৪-৫টি নোবেল পাওয়ার যোগ্য। তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব করেছেন এক মার্কিন কংগ্রেস সদস্যসহ অনেকে। ট্রাম্পের প্রতি এখন আমাদের আহ্বান, গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন। ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান করে ফিলিস্তিনে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করুন।
প্রেক্ষাপট-১
গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মিরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক মারা যান। ভারত এ হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে প্রতিশোধ গ্রহণের হুমকি দেয়। ভারতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারত সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি স্থগিত করে, ভারতে আসা পাকিস্তানিদের চলে যেতে বলে। অন্যদিকে পাকিস্তান সিমলা চুক্তি স্থগিত করে এবং পাকিস্তানের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে। পরে ভারত তার আকাশসীমায় পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে। দেশ দু’টি তাদের মধ্যকার বাণিজ্য স্থগিত এবং বন্দরগুলোতে পরস্পরের জাহাজ প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। এরপর সীমান্তে গোলাগুলি শুরু হয়। ভারত ৭ মে পাকিস্তানে হামলা চালায় এবং প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও ভারতে হামলা চালায়। পাল্টাপাল্টি হামলায় একপ্রকার যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু ১০ মে ভারতীয় সময় বিকেল ৫টা থেকে দেশ দু’টি যুদ্ধবিরতি করে, ফলে যুদ্ধ বন্ধ হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রা¤পই সর্বপ্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন, তার প্রচেষ্টাতেই যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং এ অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসে।
প্রেক্ষাপট -২
ইসরাইল গত ১৩ জুন ভোর ৪টায় হঠাৎ করে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ কারখানা এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিদের অবস্থানে হামলা করে। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের হামলায় ইরানের সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, বিপ্লবী গার্ডবাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি এবং একাধিক শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মারা যান। ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে তার জন্যই নাকি এই হামলা। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই ইসরাইলকে সমর্থন করে। ইরান পরবর্তীতে ‘ট্রু প্রমিজ ত্রি’ নামে ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালায়। এভাবে হামলা-পাল্টা হামলা চলে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গত ২১ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে হামলা করে। প্রতিক্রিয়ায় কাতার এবং ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান হামলা করে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ২৪ জুন ভোর ৪টা হতে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। এতে বিশ্ববাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এখানেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সর্বপ্রথম যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিয়ে বলেন, তার প্রচেষ্টাতেই যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য শান্তিও কামনা করেন। ইরান-ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরে আসে।
প্রেক্ষাপট-৩
ইসরাইলের লাগামহীন হামলায় পুরো গাজাই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইসরাইলের দীর্ঘ নির্যাতন এবং অবরোধের প্রতিবাদে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলে রকেট হামলা চালায়। তারপর থেকেই ইসরাইল নির্বিচারে গাজায় হামলা চালাচ্ছে। এসব হামলায় ৫৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছে এবং লক্ষাধিক আহত হয়েছে। ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরাইল তা ভঙ্গ করে এবং ১৯ মার্চ থেকে আবারো নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি হামলায় গাজার মানুষ অকাতরে মরছে। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত মানুষকেও ইসরাইল হত্যা করছে। ইসরাইলি হামলায় গাজার বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মসজিদ-গির্জা-হাসপাতাল সবই মাটিতে মিশে গেছে। ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের এবং আন্তর্জাতিক কোনো নীতিমালা মানছে না। সেখানকার সব মানুষই আজ উদ্বাস্তু এবং ত্রাণের খাবার খেয়েই বেঁচে আছে। গাজায় মানবতার চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। কিন্তু সেখানে ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনো ভূমিকা নেই। বরং ইসরাইলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের অপরাধের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘে উত্থাপিত সব প্রস্তাবই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ করে বাতিল করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেখানে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ করেছে, সেখানে ২১ মাস ধরে গাজায় চলে আসা ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধে ট্রাম্পের কোনো উদ্যোগ নেই। গাজায় এখনই ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ বন্ধে আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতি আহবান জানাই।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সবসময় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কথা বলে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে তারা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ায় আক্রমণ করে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় এবং সরকার পরিবর্তন করে। অথচ ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই ইসরাইলে হামলা এবং সরকার পরিবর্তন করে না। এরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কখনোই অবরোধ এবং নিষেধাজ্ঞা দেয় না বরং সবসময় সাহায্য করে। পশ্চিমা বিশ্ব জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট গণভোট আয়োজন করে মুসলিমপ্রধান ইন্দোনেশিয়া থেকে খ্রিষ্টানপ্রধান পূর্ব তিমুরকে এবং ২০১১ সালের ৯-১৫ জানুয়ারি গণভোট আয়োজন করে মুসলিমপ্রধান সুদান থেকে খ্রিষ্টানপ্রধান দক্ষিণ সুদানকে স্বাধীন করেছে। কিন্তু সাতাত্তর বছর ধরে চলে আসা ইসরাইলের আগ্রাসন এবং দখলদারত্ব থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিনে গণভোটের আয়োজন করেনি। বরাবরই তারা দ্বিমুখী নীতি পালন করে। তাদের প্রতিশ্রুতি সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন নয়। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের কথা এখন লোকজন তাই খুব একটা বিশ্বাস করে না। প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প যতই ভারত-পাকিস্তান এবং ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধের দাবিদার হন না কেন, ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ না করলে বিশ্ববাসী তা কখনোই বিশ্বাস করবে না। পশ্চিমাদের উচিত পক্ষপাতিত্ব ও দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ইসরাইলের উচিত-আগ্রাসন, দখলদারত্ব ও বর্বরতা চিরতরে বন্ধ করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করা। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আহবান, ইসরাইলকে থামান এবং গাজায় হত্যাকাণ্ড বন্ধ করুন।
লেখক : প্রকৌশলী
[email protected]



