সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে সমাজভিত্তিক এবং সমাজের কল্যাণে ব্যবসা। সমাজে বসবাসকারী মানুষকে সংগঠিত করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত ব্যবসাই সামাজিক ব্যবসা। সমাজে বসবাসরত মানুষের দারিদ্র্য দূর, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং জীবনমান উন্নয়ন করা এ ব্যবসার মুখ্য উদ্দেশ্য। ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে সব মানুষের সার্বিক কল্যাণ এ ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব দূর করা এবং অর্থনৈতিক খাতে টেকসই উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। সামাজিক ব্যবসা হতে পারে দারিদ্র্যদূরীকরণ ও উন্নয়নের হাতিয়ার।
সামাজিক ব্যবসায় সামাজিক প্রতিষ্ঠান
প্রতিষ্ঠান ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য হয় না। কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়। সামাজিক ব্যবসা পরিচালনা করতে তাই প্রথমে সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজে বসবাসরত মানুষজন নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে। সেটি ক্লাব, ট্রাস্ট এবং সমবায় সমিতি হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের সব সদস্যই এর অংশীদার। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করবে সুতরাং একে দেশে বিদ্যমান আইনের আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির আইনগত ভিত্তি থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট গঠনতন্ত্র এবং নীতিমালা থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় একটি বোর্ড বা কমিটি থাকবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর নতুন কমিটি নির্বাচিত হবে এবং দায়িত্ব পালন করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব অংশীদার দায়িত্ব পালন করবেন। তবে কেউ পরপর দুইবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। পাশাপাশি আর্থিক খাতে শতভাগ স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিতভাবে অডিট সম্পন্ন করতে হবে ।
ব্যবসার জন্য অর্থ সংগ্রহ : ব্যবসা-বাণিজ্য করতে অবশ্যই অর্থ লাগে। ক্রাউড ফান্ডিং বা গণ-অর্থায়ন হবে সামাজিক ব্যবসায় অর্থের প্রধান জোগানদাতা। সামাজিক ব্যবসা পরিচালনায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে কোনো ঋণ-বিনিয়োগ গ্রহণ করা হবে না। প্রাথমিকভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠানটির সদস্যরা ব্যবসায় অর্থ জোগান দেবেন। এ ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা থাকতে হবে। যেমন- একটি শেয়ারের মূল্য হবে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। একজন ব্যক্তি পাঁচ হাজার টাকা এবং তার গুণিতক যে কোনো পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবেন। অর্থাৎ সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকার যে কোনো গুণিতক পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয় নাই সমাজের এমন ব্যক্তিরাও একইভাবে পাঁচ হাজার টাকা এবং তার গুণিতক যে কোনো পরিমাণ টাকা সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে পারবেন। বিনিয়োগকারী অর্থ ফেরত চাইলে, তা তাকে সময়মতো ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা থাকতে হবে ।
সামাজিক ব্যবসার পরিধি : সামাজিক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে সামাজিক ব্যবসা পরিচালিত হবে। সামাজিক ব্যবসার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক এবং বিস্তৃত। প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে কৃষিভিত্তিক ব্যবসা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে, সময়ের সাথে যা আরো বড় পরিসরে করা যেতে পারে। গরু পালন (দুধ উৎপাদন ও গরু মোটাতাজাকরণ), ছাগল-ভেড়া পালন, হাঁস-মুরগি পালন (ডিম এবং মাৎস্য উৎপাদন), মাছ চাষ এবং সবজি চাষ যে কোনো একটি কৃষিভিত্তিক ব্যবসা দিয়ে প্রথমে শুরু করা যেতে পারে। গরু লালন-পালনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ঘর তৈরি করতে হবে, ভালো জাতের গরু কিনতে হবে এবং জমিতে উন্নত প্রজাতির ঘাসের চাষ করতে হবে। উৎপাদিত দুধ থেকে বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টিজাতীয় খাদ্য তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে। গরু, ছাগল এবং মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে জৈব সার তৈরি করা যাবে, যা ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। ঈদুল আজহাসহ বছরব্যাপী গরু-ছাগলের চামড়া সংরক্ষণ প্রকল্প এবং বৃক্ষরোপণও এ ব্যবসার অংশ হতে পারে। এলাকার পুকুর এবং জলাধারগুলো সংস্কার করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করা যেতে পারে। বন্যার পানিতে যাতে ডুবে না যায় সে জন্য পুকুরের পাড় উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। পাড়সমূহে কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, জামবুরাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদির চাষ করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে সমাজের মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি ব্যবসায় সফলতা অর্জনের পর অন্য ব্যবসা শুরু করতে হবে। দ্বিতীয় ব্যবসার সফলতার পর তৃতীয় ব্যবসা এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে ব্যবসা বাড়াতে হবে।
ব্যবসার আয়-ব্যয় এবং মুনাফার বণ্টন : মুনাফা অর্জন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে কোনো ব্যবসা টিকতে পারে না। সুতরাং সামাজিক ব্যবসায়েও অবশ্যই মুনাফা অর্জন করতে হবে। অর্জিত মুনাফা বণ্টনে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। প্রথমে বিনিয়োগ করা অর্থের বিপরীতে মুনাফা দিতে হবে। তা না হলে মানুষ অর্থ বিনিয়োগ করবে না। বিনিয়োগকৃত অর্থের বিপরীতে মুনাফা প্রদানের নীতিমালা থাকা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত ব্যাংক রেটের দ্বিগুণ মুনাফা প্রদান একটি মানদণ্ড হতে পারে। বর্তমানে ব্যাংক রেট হচ্ছে চার শতাংশ। সুতরাং বিনিয়োগীদের এর দ্বিগুণ অর্থাৎ আট শতাংশ হারে মুনাফা প্রদান করা যায়। এটি যুক্তিসঙ্গত। বর্তমানে একজন মানুষ ব্যাংকে টাকা ডিপোজিট রাখলে ৮-৯ শতাংশ হারে সুদ বা মুনাফা পান। অন্য দিকে ব্যাংক হতে ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রহণ করে ব্যবসা করলে তার বিপরীতে ব্যবসায়ীকে ১৫-১৬ শতাংশ হারে সুদ বা মুনাফা প্রদান করতে হয়। সুতরাং সামাজিক ব্যবসায় ব্যাংক রেটের দ্বিগুণ হিসাবে মুনাফা প্রদান করলে বিনিয়োগকারী সন্তুষ্ট হবেন, আবার সামাজিক ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানও লাভবান হবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীকে প্রদত্ত সুদ বা মুনাফা, ব্যাংক হতে গৃহীত ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে প্রদত্ত সুদ বা মুনাফার অর্ধেক। ফলে ব্যবসার পরিচালনা ব্যয় কম হবে, মুনাফা বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যবসা পরিচালনা ও ব্যবসায় টিকে থাকা সহজ হবে। ব্যাংক রেট পরিবর্তন হলে মুনাফার হারও পরিবর্তন হবে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পরিচালকদের যথাযথ বেতন ভাতা এবং সম্মানী দিতে হবে। বাকি মুনাফার অর্ধেক ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চিতি তহবিলে এবং বাকি অর্ধেক সামাজিক সমস্যা সমাধানে সিএসআর (সামাজিক দায়বদ্ধতা) তহবিলে জমা রাখতে হবে ।
সামাজিক কল্যাণে সামাজিক ব্যবসা : সামাজিক ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের মানুষের কল্যাণ। সিএসআর তহবিল হতে সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায়, গরিব পরিবারের সন্তানদের বিয়েতে এবং গরিব ব্যক্তিদের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা করতে হবে। গরিব পুরুষদের রিকশা-ভ্যানগাড়ি, মেয়েদের সেলাই মেশিন ক্রয়ে এবং বুটিক ব্যবসায় কর্জে হাসানা প্রদান করতে হবে, যা পরবর্তীতে তারা আয় করে দায় শোধ করবেন। একটি লাইব্রেরি স্থাপন করতে হবে যেখানে ধর্ম, দর্শন, সভ্যতা, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই থাকবে। মানুষ অবসর সময়ে সেখানে পড়াশোনা করবেন, ফলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে। এলাকার রাস্তাঘাট-কালভার্ট মেরামত, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য এবং শীতকালে গরিবদের শীতবস্ত্র প্রদানসহ মানবকল্যাণে কাজ করতে হবে। এলাকার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি নির্মূলে, নারী নির্যাতন এবং ইভটিজিং প্রতিরোধে সামাজিক প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। ফলে সমাজে আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকবে, মানুষের মাঝে সাম্য-ভ্রাতৃত্ব বাড়বে এবং শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন তারা। মোট কথা সামাজিক প্রতিষ্ঠান সব ধরনের ভালো কাজের বিকাশে এবং মন্দ কাজ নির্মূলে প্রচেষ্টা চালাবে।
উপসংহার : শুরু করাই আসল কাজ। আরম্ভ করলে তা সময়ের ব্যবধানে বড় হয়। আসুন নিজ নিজ এলাকায় সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সামাজিক ব্যবসা শুরু করি। এতে গ্রামেগঞ্জে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব দূর হবে, সমাজে ঐক্য এবং শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে, মানুষ শহরে কম অভিবাসী হবেন। এতে করে শহরে জনচাপ ও যানজট কমবে। সেই সাথে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে। ধনী এবং গরিবের মধ্যে আর্থিক ব্যবধান কমবে। এভাবে দেশব্যাপী গ্রামেগঞ্জে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হবে। দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে, যা হবে টেকসই এবং স্থায়ী ।
লেখক : প্রকৌশলী
omar_ctg123@yaho



