মীরজাফররা নতুনরূপে যেন ফিরে আসতে না পারে

দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে আমরা এখনো মুক্ত নই। আমাদের এমন একজন অভিভাবকের প্রয়োজন যিনি পরাশক্তির আধিপত্যবাদী রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে একটি কথা আছেÑ যুগে যুগে মীর জাফররা নতুনরূপে ফিরে আসে, তাই আমাদের একজন দূরদর্শী নেতাকে সাহায্য করতে সৎ, গতিশীল এবং সাহসী দেশপ্রেমিক নাগরিক প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বাইরে এবং ভেতরে থেকে অব্যাহত থাকবে; কিন্তু আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে কোনো মীর জাফর বা তাদের এজেন্ট সফল হবে না ইনশা আল্লাহ

আজ থেকে প্রায় ২৬৮ বছর আগে বাংলার ইতিহাসের সাথে একটি নাম যুক্ত হয় ‘মীর জাফর’। মীর জাফর সম্পর্কে কেউ জানুন বা না জানুন নামটি বর্তমানে আমাদের সমাজে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিলুপ্তের মূল কারিগর ছিলেন মীর জাফর আর তার বিশ্বাসঘাতকতার উল্লেখযোগ্য মূল কারণ ছিলেন একজন নারী।

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণ সম্পর্কে এ প্রবন্ধে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে চাই। বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিলে মুন্নি বাঈ নামে এক নর্তকীর কারণে। নবাব আলীবর্দি খানের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় নবাবের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানম সাহিবাকে বিয়ে করেন মীর জাফর। ঘষেটি বেগমের দত্তক সন্তান একরামুদৌল্লার বিয়েতে পারস্য থেকে মুর্শিদাবাদে আসা নর্তকী দলের এক সদস্য ছিল সুন্দর দেহবল্লবীর অধিকারিণী মুন্নি বাঈ। যে কিনা কিছু দিনের মধ্যে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের নজর কাড়ে। আমাদের সমাজে পতিতাদের যেমন কেউ চাইলে বিয়ে করতে পারে না, তেমনি দাসীদের বিয়ে করা গেলেও তৎকালে নর্তকীকে বিয়ে করা- পতিতাকে বিয়ে করার সমতুল্য ছিল। যেহেতু মুন্নি একজন নর্তকী ছিল, তাই তাকে নিজের অধিকারে রাখতে চেয়েছিলেন মীর জাফর। অধিকারের নেশা এমনই যে, ন্যায়নীতি আদর্শ ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে আত্মতুষ্টি লাভে উদগ্রীব হয়ে ওঠে আত্মসুখে। সার্বিক দিক বিবেচনায়, মীর জাফর চাইলেও মুন্নিকে বিয়ে করে ঘরে তোলার সাহস দেখাতে পারেননি।

রায়বল্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে দিয়ে নবাব হওয়ার প্রস্তাব দেয় মীর জাফরকে। এর মধ্য দিয়ে তার এত দিনের ইচ্ছা পূরণের সুযোগ হয়। অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়। লোকলজ্জা দু’পায়ে মাড়িয়ে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ মীর জাফর এক নাচনেওয়ালিকে বিয়ে করে ইতিহাসে প্রথমবার নর্তকীকে বেগমের মর্যাদা দেন। তিনি পরবর্তী সময়ে রব্বু বাঈ নামে অন্য এক নর্তকীকেও বিয়ে করেন। মীর জাফরের মৃত্যুর পর তার আসনে বসার নৈতিক অধিকার ছিল শাহ খানমের ছেলে মীরনের। কিন্তু রবার্ট ক্ল¬াইভকে তৎকালীন পাঁচ লাখ রুপি দিয়ে মসনদে বসান মুন্নি বাঈ নিজের ছেলেকে। এভাবে ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখেন মুন্নি বাঈ।

মীর জাফরের মৃত্যুর পর থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দুই নর্তকীর গর্ভজাত সন্তান এবং তাদের উত্তরাধিকাররা ইংরেজদের অনুগত হয়ে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব ছিল। কিন্তু তাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়নি। এভাবে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমরা ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমতা হারিয়েছি। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, কেবল তাদের নিজস্ব লোকেরা ব্যক্তিগত স্বার্থে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ইতিহাসের হয়তো এভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটে। মীর জাফরের বংশধর (সপ্তম প্রজন্ম) মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে তিনি ১৯৫৫ থেকে পাকিস্তানের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল এবং অক্টোবর ১৯৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার অধীনে পূর্ববাংলার তিনজন প্রধানমন্ত্রী (খাজা নাজিমুদ্দিন, বগুড়ার চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং সোহরাওয়ার্দী) দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে সহজে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে পারতেন। কিন্তু মীর জাফরের মতো পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আইয়ুব খানের পরামর্শে পাকিস্তানের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। ঠিক একইভাবে কিছু দিনের ব্যবধানে তাকেও ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আইয়ুব খান। শুধু তাই নয়, তাকে এক কাপড়ে লন্ডনে নির্বাসিত করেন। এমনকি মৃত্যুর পর তার লাশটিও নিজ জন্মভূমিতে আসার অনুমতি দেননি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান। অথচ তার হাতে সুযোগ ছিল, যে বাংলাকে তার প্রপিতামহ মীর জাফর ব্রিটিশদের হাতে সোপর্দ করে বিশ্বাসঘাতকের নাম পেয়েছিল, সেই বাংলাকে নতুনভাবে গড়তে। কিন্তু তিনি তা করেননি। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কোনো বিশ্বাসঘাতক অতীতের বংশধর হলেও সে ভবিষ্যতের বিশ্বাসঘাতকের পিতাও।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনেও গভীর ষড়যন্ত্র হয়েছিল। পাকিস্তানের শাসকদের ভুল নীতি এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয়তা একটি নতুন ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে। অবশেষে ২৩ বছর পর পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি ও এলিটদের শোষণ, অপমান থেকে একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরও ষড়যন্ত্র থামেনি। অনেক উত্থান-পতনের পর আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিলাম; কিন্তু কিছু রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ীর মতো কিছু মীর জাফর ব্যক্তিগত স্বার্থে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল বিদেশী শক্তির অধীনস্থ থাকা। যুগে যুগে মীর জাফররা তাদের উত্তরসূরি রেখে যায়।

পলাশী প্রান্তরের পরিস্থিতি আমলাদের নিয়ে সামাল দিতে নবাব সিরাজ রাজকোষ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন; কিন্তু তারা রাজকোষ থেকে অর্থ নিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করে রাজধানীকে রক্ষার বদলে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। একজন সরকারি কর্মকর্তার প্রধান দায়িত্ব দেশ ও জাতির স্বার্থে সাহসের সাথে কাজ করা। কিন্তু আমরা যদি দেশের কর্মকর্তাদের লক্ষ করি, তা হলে দেখা যাবে, তারা নিজেদের স্বার্থে এমন কোনো কাজ নেই; যা করেন না। যেখানে বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করা নৈতিক দায়িত্বে পড়ে, সেখানে তারা ক্ষুদ্রতর স্বার্থে, ক্ষমতা ও অর্থের লোভে দুর্নীতির চরম পর্যায়ে গিয়ে অবলীলায় দেশ-জাতির বৃহত্তর ক্ষতি করেন। দেশকে চরম বিপদে ঠেলে দেন। এ রকম দু’জন বড় মীর জাফর হলেন ওয়ান-ইলেভেনের মাস্টারমাইন্ড জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এবং লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী জিওসি, সাভার (প্রাক্তন রক্ষীবাহিনী)। ওয়ান-ইলেভেনে ব্যক্তিগত স্বার্থে তারা বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাকে সহযোগিতা করে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। সেই সময়ের পটপরিবর্তনের অন্যতম খলনায়ক ছিলেন তারা, ফলে পরবর্তী সময়ে দেশে স্বৈরচারী শাসনের সূচনা হয়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার লেখা বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারসে’ লিখেছেন, ‘২০০৮ সালে সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ আমার কাছে আসেন এবং আমার কাছে প্রত্যাশা করেন যাতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তাকে তার পদে বহাল রাখা হয়। এ ব্যাপারে আমি তাকে নিশ্চয়তা দিই। পরবর্তী সময়ে ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী মইনকে সেনাপ্রধানের পদে বহাল রাখেন শেখ হাসিনা।’

একই ভাবে, যেখানে দেশ ও জাতির স্বার্থে সাহসের সাথে কাজ করার কথা, সেখানে কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের অবৈধ আদেশ পালন করেন। দেশ এবং দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে যা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ষড়যন্ত্রকারীদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। তবু ষড়যন্ত্রকারীরা চক্রান্ত চালিয়ে যাবে। বাংলাদেশে প্রভাব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। কোনোকালে বিশ্বাসঘাতকরা পিছু ছাড়ে না। এখন সময় এসেছে জরুরি ভিত্তিতে এসব বিশ্বাসঘাতককে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার। সেই সাথে তাদের সম্মিলিতভাবে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা নিশ্চিহ্ন করার।

এখন আমাদের বিভক্তির সময় নয়, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সময় নয়, বিশৃঙ্খলা তৈরির সময় নয়। আমাদের মতের অমিল হতে পারে, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে পারি, নিজেদের মধ্যে গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারি; কিন্তু আমরা বিভেদ, বিভক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের দুর্বল করে তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ করে দিতে পারি না।

মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের সাথে আমাদের জাতীয় স্বার্থে কূটনৈতিক কারণে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে; কিন্তু বন্ধুত্বের নামে দাসত্বের সম্পর্ক আর নয়। আমাদের দেশ যেমনই হোক না কেন, দিন শেষে তা নিজেদের প্রিয় মাতৃভূমি। দল, মত, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে যত দ্রুত বিষয়টি অন্তরে ধারণ করতে পারব, তত দ্রুত আমাদের জন্য, রাষ্ট্র সংস্কারে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আমাদের কখনো ভুলে গেলে চলবে না শহীদদের রক্তের কথা, যাদের অঙ্গহানি হয়েছে তাদের কষ্টের কথা, সর্বোপরি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা।

দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে আমরা এখনো মুক্ত নই। আমাদের এমন একজন অভিভাবকের প্রয়োজন যিনি পরাশক্তির আধিপত্যবাদী রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে একটি কথা আছে যুগে যুগে মীর জাফররা নতুনরূপে ফিরে আসে, তাই আমাদের একজন দূরদর্শী নেতাকে সাহায্য করতে সৎ, গতিশীল এবং সাহসী দেশপ্রেমিক নাগরিক প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বাইরে এবং ভেতরে থেকে অব্যাহত থাকবে; কিন্তু আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে কোনো মীর জাফর বা তাদের এজেন্ট সফল হবে না ইনশা আল্লাহ। পাশাপাশি অতি দ্রুত কলেজছাত্রদের সামরিক ভূমিকায় প্রশিক্ষণ করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত; যাতে কেউ কখনো ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়কার মতো বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে, আমাদের সৈন্য এবং ছাত্ররা তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হন। মীর জাফররা যেন নতুনরূপে ফিরে না আসে। বিশ্বাসঘাতকতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হতে পারে, তবে সে ব্যথা স্থায়ীভাবে কতটা ক্ষতি করে তা আমাদের ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করবে।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও প্রোভিসি, বিইউপি