ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল ও রাজনীতির সৌন্দর্য

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এ কথাটি আমাদের দেশের রাজনীতিতে বেশ জোরালোভাবে প্রচলিত আছে। যার মূল কথা হচ্ছে : ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নৈতিক, অনৈতিক যেকোনো পন্থা অবলম্বন করা যায়। আবার একই কারণে দলবদলের ঘটনাও এ দেশে অহরহ ঘটে থাকে। যাকে বলা হয়, ‘নীতি ও দলবদলের রাজনীতি’। প্রায় ৪ দশক আগে ওই শিরোনামে তৎকালীন ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রায়’ আমার একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময় সেই আশির দশকে অনেক রাজনীতিকের দলবদলের নাটকীয় ঘটনা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। তখন এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, বিকেলে একজন এরশাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, রাতে টিভির পর্দায় দেখা গেল তিনি এরশাদের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। সবই রাজনীতিবিদরা জায়েজ করে ফেলেন ওই একটি কথা বলে- রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করার নোংরা কৌশলকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে ওই শব্দমালা ব্যবহার করা হয়। অথচ রাজনীতি হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য। দার্শনিক অ্যারিস্টটল রাজনীতিকে একটি শিল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমাদের দেশের বিখ্যাত সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান ১৯৭৯ সালে তার এক নির্বাচনী সমাবেশে বলেছিলেন, ‘রাজনীতি হচ্ছে কবিতার মতো সুন্দর।’ কিন্তু সেই রাজনীতি আজ অসুন্দর হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সবধরনের অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব নোংরা পন্থাগুলোকে জায়েজ করার জন্যই আমরা বলে থাকি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

মূলত বেঞ্জামিন ডিসরেইলি নামক একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ যিনি দু’বার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনিই প্রথম বলেন যে, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই।’ কিন্তু আমরা ওটাকে বানিয়েছি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। দু’টি উক্তির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। যেমন বেঞ্জামিনের উক্তি থেকে এটা বোঝা যায় যে, আপনি একটি ইস্যুতে হেরে গেছেন আরেকটি ইস্যুতে জিতে যাবেন। কিংবা এবার আপনি নির্বাচনে পরাজিত হলেন পরেরবার আপনি নির্বাচনে জয়লাভ করবেন বা জয়লাভের সুযোগ থেকে যায়। তাই রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। যুদ্ধের ক্ষেত্রে শেষ বলে কিছু নেই।

যেমন স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুসের কাহিনীটির কথা ধরা যাক। তিনি যুদ্ধে বারবার পরাজিত হচ্ছিলেন। এভাবে ছয়বার পরাজিত হয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েন। অবশেষে জঙ্গলের মধ্যে একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি লক্ষ করেন যে, একটি মাকড়সা জাল বুনতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এভাবে সে ছয়বার ব্যর্থ হওয়ার পর সপ্তমবার সফল হয়। এটা দেখে রাজা খুব অনুপ্রাণিত হন। তিনি গুহা থেকে বেরিয়ে আসেন। হতাশা ছুড়ে ফেলে দিয়ে সপ্তমবার তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বিজয় লাভ করেন।

সুতরাং রাজনীতিও একটি যুদ্ধ, তাই রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই; কিন্তু আমরা যখন বলি, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই, তখন অন্য একটি অর্থ আমাদের সামনে হাজির হয়। অর্থাৎ রাজনীতিতে লক্ষ্য অর্জনে নৈতিক এবং অনৈতিক যেকোনো পন্থা অবলম্বন করা জায়েজ হয়ে যায়। কিংবা যে শত্রুকে আপনি আন্দোলন করে পতন ঘটিয়েছিলেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তার সাথে আঁতাত করা ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অহরহ ঘটে থাকে।

এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার আঁতাতের কথা উল্লেখ করা যায়। এই দলটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালেই ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে এসে গঠিত হয়েছিল। তাত্তি¡ক নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণার ওপর ভিত্তি করে জাসদ নামক দলটি গঠিত হয়। এই দলটি গোড়া থেকেই সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্ন দেখত। সে জন্য তারা গঠন করেছিল একটি সামরিক শাখা, যার নাম ছিল গণবাহিনী। এই বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ছিলেন হাসানুল হক ইনু। তার নেতৃত্বে সংগঠনটির সশস্ত্র ক্যাডারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা শুধু ক্ষমতায় যাওয়া এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে কেবল জোট গঠন করেই ক্ষান্ত থাকেননি তাকে মন্ত্রীও বানিয়েছিলেন। এর সাথে রাজনীতি, সুনীতি, নৈতিকতা ও আদর্শের কোনো বালাই ছিল না। ছিল শুধু ক্ষমতায় যাওয়া ও প্রতিশোধ গ্রহণের অভিলাষ। যদিও সেই সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ দলীয় এক সভায় বলেছিলেন, ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলই শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।’

আবার ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর নেতাকর্মীরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করলে রক্ষীবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পেছনে রেখে হাসানুল হক ইনুর আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করার ঘটনা সেই একই নীতি ও আদর্শহীনতার পরিচয় বহন করছে। তখন ’৭২-৭৫ সালে আওয়ামী শাসনামলে জাসদের শত শত নেতা ও কর্মী রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল। সেসব নিহতের আত্মার প্রতি এমন বেঈমানি কিংবা সেসব পরিবারের প্রতি এমন অবজ্ঞা প্রদর্শন হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতিতেই সম্ভব, যেটা হাসানুল হক ইনু করেছিলেন। দোহাই একটাই- রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

এমনকি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের সাথে আঁতাত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। সেই কারণে একটি নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আই এম নট আনহ্যাপি’। অথচ তিনি কথায় কথায় বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট দল হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।

আরো মজার ঘটনা হচ্ছে যে, শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতাকর্মীরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সবসময় বিভোর থাকলেও শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগে ১৫ দলীয় যে জোট গঠন করেছিলেন, তাতে এমন এক ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যিনি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন সাম্যবাদী দলের সভাপতি মো: তোয়াহা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ছিলেন। সে সময় তিনি পাকিস্তান আর্মি ও মুক্তিযোদ্ধা উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও স্বাধীনতাযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলেছিলেন।

সুতরাং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এরকম অনৈতিক অবস্থান গ্রহণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতি সাধারণ একটি চিত্র। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঠিক একই ধরনের আলামত ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ পতিত ফ্যাসিস্টদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের পুনর্বাসন করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। আর সেটি হতেই পারে এ কারণে যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই!

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক