আবু এন এম ওয়াহিদ
মানব ইতিহাসে বিজ্ঞান এক দিকে যত এগিয়েছে, অন্য দিকে বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের মৌলিক ধারণাগুলো ততবার বদলেছে। প্রাচীন যুগের পঞ্চভৌতিক ধারণা থেকে নিউটনের গতিসূত্র, সেখান থেকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা প্রতিটি ধাপে আমরা বিশ্বের প্রকৃতি দেখার নতুন নতুন লেন্স পেয়েছি। কিন্তু এ বিপুল অগ্রগতির পথের সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব হলো : বিশ্ব কি সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত ও পূর্বনির্ধারিত, নাকি মূলগতভাবে অনির্ণেয় ও সম্ভাবনামূলক? এ দ্বন্দ্ব নির্ধারণবাদ বনাম কোয়ান্টাম অনির্ণেয়তার লড়াই। এ লড়াই শুধু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রশ্ন নয়; বরং বাস্তবতার প্রকৃতি, সমগ্র মহাবিশ্বের কাঠামো, এমনকি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার প্রশ্ন ঘিরে এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ।
১. নির্ধারণবাদের জন্ম : গ্রিক দর্শন থেকে নিউটনিয়ান পদার্থবিদ্যা
মানুষের প্রকৃতি বুঝতে উৎসাহী যেসব প্রাচীন সভ্যতা ছিল, তার মধ্যে গ্রিকদের চিন্তাভাবনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তারা বিশ্বাস করতেন, বিশ্ব একটি যৌক্তিক কাঠামোয় সাজানো। ডেমোক্রিটাস মনে করতেন, মহাবিশ্ব গঠিত কেবল পরমাণু ও শূন্যস্থান থেকে আর এদের গতি যথাযথ নিয়ম মেনে চলে। স্টোইক (প্রাচীন গ্রিক দর্শনের একটি বিশেষ ধারা) দার্শনিকরা বলতেন : এভরিথিং ফলোস ফ্রম নেচারাল ল। ফ্রি উইল ইস অ্যান ইলুসন।
এই ভাবনাই মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, ইবনে খালদুনদের মধ্যেও বিভিন্নরূপে দেখা যায়। তাদের মতে-বিশ্বে একটি গোছানো বিধান আছে, যা আল্লাহর সৃষ্ট নীতির বিস্ময়কর বহিঃপ্রকাশ!
কিন্তু বিজ্ঞানকে প্রকৃত নির্ধারণবাদের স্পর্শ ও তাত্ত্বিক ভিত্তি দেন আইজ্যাক নিউটন। তিনি ১৬৮৭ সালে প্রিনসিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা প্রকাশ করে দেখালেন : একই নিয়মে আপেল পড়ে, একই নিয়মে চাঁদ ঘোরে, একই নিয়মে সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হয়। প্রথমবারের মতো মানুষ বুঝল-মহাবিশ্ব এক বিশাল যান্ত্রিক কাঠামো, যেখানে প্রতিটি ঘটনার কারণ আগে নির্ধারিত। লাপ্লাস পরে বলেন : গিভেন দ্য স্টেট অব দ্য ইউনিভার্স অ্যাট ওয়ান মোমেন্ট, এ সাফিসিয়েন্টলি পাওয়ারফুল ইন্টেলিজেন্স ক্যান প্রেডিক্ট ইটস এনটায়ার ফিউচার। এটিই লাপ্লাসীয় নির্ধারণবাদ, যা পরবর্তী ২০০ বছরে বিজ্ঞানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
২. আইনস্টাইন : নির্ধারণবাদের সর্বশেষ মহান সুরকার
বিশ শতকে এসে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার মাধ্যমে নির্ধারণবাদকে আরো সুদৃঢ় করে গড়ে তোলেন। তিনি বলেন, মহাবিশ্বের গতি, সময় ও স্থানের কাঠামো, আলোর আচরণ-সবকিছু নির্ভুল সব সমীকরণে বাঁধা। এই বিজ্ঞানীর কাছে প্রকৃতি কেবল যুক্তিনির্ভর নয়; বরং অদ্ভুতভাবে সুন্দর-যেন কোনো মহাজাগতিক সঙ্গীত পরিচালনার অদৃশ্য সুরের মতো। এ কারণে তিনি বলেছিলেন : এভরিথিং ইস ডিটারমাইন্ড... উই অল ড্যান্স টু এ মিস্টিরিয়াস টিউন, ইনটোন্ড ইন দ্য ডিসট্যান্স বাই অ্যান ইনভিসিবল পাইপার। এখানে পাইপার বলতে তিনি ধর্মীয় অর্থে গডকে বুঝাননি; বরং বুঝাচ্ছিলেন-প্রকৃতির গভীর ও নির্দিষ্ট, গণিতভিত্তিক নিয়মকে।
৩. বিজ্ঞান অগ্রসর হয়; কিন্তু বাস্তবতা সহজ নয়
যদিও নিউটনের মডেল বৃহৎ পরিসরে (গ্রহ-নক্ষত্র, মহাজাগতিক গতিবিদ্যা) অভ‚তপূর্ব সফলতা পায়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিজ্ঞানীরা লক্ষ করলেন, অতি ক্ষুদ্র পর্যায়ে-পরমাণু ও কণার জগতে নিউটনের সমীকরণগুলো বিশালভাবে ভেঙে পড়ছে। ক. ইলেকট্রনের অবস্থান, খ. আলোতেও বস্তুর মিথস্ক্রিয়া, গ. শক্তির কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য- সবকিছু প্রচলিত নির্ধারণবাদী বর্ণনা থেকে বেয়াড়াভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে। এভাবে জন্ম নিল কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তখন থেকে নির্ধারণবাদ বনাম অনির্ণেয়তার যুদ্ধ শুরু।
৪. কোয়ান্টাম অনির্ণেয়তার আবির্ভাব
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলল : ক. কোনো কণার অবস্থান ও বেগ একসাথে নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব নয়। খ. কণাগুলো ক্ষুদ্র বল নয়; বরং তারা তরঙ্গের মতো আচরণ করে। গ. কোনো কণা পরিমাপ করার আগে তার স্পষ্ট মান থাকে না, শুধু একটি সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ, সবচেয়ে মৌলিক স্তরে বাস্তবতা হচ্ছে- সম্ভাবনার ঢেউ মাত্র। নিশ্চিতভাবে কোনো জিনিস নয়। বাস্তবতার এ সম্ভাবনামূলক প্রকৃতি নির্ধারণবাদকে মারত্মকভাবে আঘাত করল। খোদ আইনস্টাইন পর্যন্ত বলেছিলেন : কোয়ান্টাম থিওরি ইজ ইনকমপ্লিট। কোয়ান্টাম তত্ত¡ অসম্পূর্ণ। তিনি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না, প্রকৃতি মূলগতভাবে অনিশ্চিত হতে পারে। তার মতে, অনিশ্চয়তা মানে ‘আমরা এখনো পুরো সত্য জানি না’- তাহলে আরো গভীরে এমন কোনো নিয়ম আছে, যা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না।
৫. বোহর-আইনস্টাইন বিতর্ক : বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর সংঘর্ষ
কোয়ান্টাম তত্তে¡র অন্যতম স্থপতি নীল্স বোহর ছিলেন ঠিক আইনস্টাইনের বিপরীত। বোহরের মতে : ক. অনিশ্চয়তা কোনো অপূর্ণতা নয়; প্রকৃতিই অনির্ণেয়। খ. পরিমাপের (মেজারমেন্ট) আগ পর্যন্ত কণার নির্দিষ্ট অবস্থা থাকে না। গ. বাস্তবতা আমাদের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, জগৎ পর্যবেক্ষণের আগে নির্দিষ্ট নয়- এটা এক অদ্ভুত সম্ভাবনার সুপারপজিশন মাত্র।
এর প্রতিউত্তরে আইনস্টাইন রেগে গিয়ে বলেছিলেন : ডু ইউ রিয়ালি বিলিভ, দ্য মুন ইস নট দেয়ার হোয়েন ইউ আর নট লুকিং অ্যাট ইট? তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো যে, চাঁদ নেই যখন কেউ তাকাচ্ছে না? বোহরের উত্তর ছিল আরো তীক্ষ্ণ : আইনস্টাইন, স্টপ টেইলিং গড হোয়াট টু ডু। অর্থাৎ, আইনস্টাইন, ঈশ্বরকে কী করতে হবে তা তুমি বলে দিও না। এই সংঘর্ষ বিজ্ঞানের দার্শনিক গভীরতা এমন একপর্যায়ে নিয়ে গেল যা আজও শেষ হয়নি।
৬. কোয়ান্টাম জড়তা : লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়
আইনস্টাইন, পডলস্কি এবং রোজেন (ইপিআর) একটি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে দেখাতে চাইলেন যে, কোয়ান্টাম তত্ত¡ অসম্পূর্ণ। তারা একটি জড়িত কণার যুগল নিয়ে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এক কণাকে পরিমাপ করলে অন্য কণা ‘তৎক্ষণাৎ’ প্রভাবিত হয় যা আলোর গতিকে লঙ্ঘন করে। আইনস্টাইন একে বলেছিলেন : স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট এ ডিসট্যান্স। দূর থেকে ভ‚তের মতো ক্রিয়া। তিনি দেখাতে চাইছিলেন যে, এর নিচে অবশ্যই কোনো ‘গোপন ভেরিয়েবল’ আছে যা নির্ধারণবাদকে রক্ষা করবে। কিন্তু... ১৯৬৪ সালে জন বেল দেখালেন তার বেল’স থিওরেম, যা বলে : ক. যদি কোয়ান্টাম তত্ত¡ সত্য হয়, তাহলে এ জড়তা কোনো লুকানো নিয়মের ফল হতে পারে না। খ. মহাবিশ্ব মূলগতভাবে নির্ধারণবাদী- এ ধারণা রেখে কোয়ান্টাম ফল ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। পরে অসংখ্য পরীক্ষায় প্রমাণ মিলে কোয়ান্টাম জড়তা সত্যই প্রকৃতির একটি বৈশিষ্ট্য। এভাবে আইনস্টাইনের নির্ধারণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষুদ্র কণাজগতের ক্ষেত্রে টিকে থাকতে পারল না।
৭. তাহলে কি নির্ধারণবাদ শেষ হয়ে গেল?
না-আশ্চর্যের বিষয়, তথাপি নির্ধারণবাদ পুরোপুরি মরে যায়নি। (ক) বৃহৎ স্কেলে নির্ধারণবাদ এখনো কার্যকর। গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সির গতি পুরোপুরি নিউটন-আইনস্টাইনের নির্ধারণবাদী নিয়মে চলে। মহাবিশ্বের গতিপথ অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে পূর্বাভাস করা যায়। (খ) অরাজকতা তত্ত¡ (ক্যাওয়াস থিওরি) এটা বলে : বিশ্ব পুরোপুরি নির্ধারণবাদী হলেও ক্ষুদ্র পরিবর্তন ভবিষ্যৎকে অগণিত পথে চালিত করতে পারে। অর্থাৎ, নির্ধারণবাদ পূর্বাভাসযোগ্যতা। (গ) কোয়ান্টাম তত্তে¡র কিছু ব্যাখ্যা আবার নির্ধারণবাদকে রক্ষা করে যেমন- বোহমিয়ান মেকানিক্স, যেখানে কোয়ান্টাম তরঙ্গ অপূর্ণতা নয়; বরং একটি গভীর লুকানো কাঠামোর প্রতিফলন। ডেভিড বোম দেখিয়েছিলেন যে, বাস্তবতার নিচে হয়তো আরো নির্ধারক স্তর আছে। (ঘ) মাল্টিভার্স ধারণামতে, একাধিক মহাবিশ্ব একসাথে বিদ্যমান এ ধারণা বলছে, প্রতিটি সম্ভাবনা একটি নতুন মহাবিশ্বে বাস্তব হয়। তাহলে বর্তমান মহাবিশ্বে ‘অপ্রত্যাশিত’ যা মনে হয়, তা বৃহত্তর বাস্তবতার একটি খণ্ডিতাংশ মাত্র।
৮. অনির্ণেয়তা কি তাহলে পুরোপুরি বিজয়ী?
এটাও নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স দেখিয়েছে : ক. মৌলিক স্তরে ঘটনাগুলো সম্ভাবনা-নির্ভর। খ. কণার আচরণ পরিমাপের ওপর নির্ভর করে। গ. নির্দিষ্ট মান, পরিমাপের আগে নেই- এ শুধু সম্ভাবনার তরঙ্গ। কিন্তু আমরা এখনো জানি না : ক. এ সম্ভাবনা কোথা থেকে আসে? খ. তরঙ্গফাংশন কেন এবং কিভাবে কলাপ্স করে? গ. বাস্তবতা কি কোয়ান্টাম তথ্যের ওপর নির্মিত? অর্থাৎ, অনির্ণেয়তাও বাস্তব প্রকৃতির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নয়।
৯. বিজ্ঞানের গভীর সত্য : দু’টি স্তর
বাস্তবে আমরা একটি দ্বৈত বিশ্বে বাস করি। উপরের স্তর : গ্রহ, নদী, মানুষের জীবন-সব নির্ধারণবাদী প্রায় সম্পূর্ণভাবে। এখানে কারণ-কার্য সম্পর্ক খুব স্পষ্ট। নিচের স্তর : ইলেকট্রন, ফোটন, কোয়ার্ক এদের জগত সম্পূর্ণ সম্ভাবনামূলক। এখানে অনিশ্চয়তা নিশ্চয়তার একমাত্র নিয়ম। তাই বিজ্ঞান আজ বলে : মহাবিশ্ব একই সাথে নির্ধারণবাদী এবং অনির্ণেয় দুই ধরনের নিয়ম একই বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন আত্মপ্রকাশ।
১০. দার্শনিক প্রভাব : স্বাধীন ইচ্ছা ও মানুষের ভাগ্য
এ বিতর্ক মানবদর্শনের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। নির্ধারণবাদ বলে- মানুষের ইচ্ছা আসলে একটি ভ্রম। সব সিদ্ধান্ত পূর্ববর্তী কারণ দ্বারা নির্ধারিত। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে- মহাবিশ্বের গভীরে অনিশ্চয়তা আছে। এ থেকে হয়তো কিছু পরিমাণ স্বাধীনতা জন্মায়। তবে এটা বলা ভুল যে, কোয়ান্টামের অনির্ণেয়তা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা। তবু এটি আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার নতুন জানালা খুলে দেয়।
১১. উপসংহার : মহাবিশ্ব-এক কঠিন ও জটিল দ্বৈত নৃত্য
নির্ধারণবাদ আমাদের শেখায় : বিশ্বে নিয়ম আছে; কারণ-কার্য সম্পর্ক আছে : প্রকৃতি বিশৃঙ্খল নয়। কিন্তু কোয়ান্টাম অনির্ণেয়তা আমাদের শেখায় : গভীরে অনিশ্চয়তা আছে প্রকৃতি সম্ভাবনামূলক; আমাদের জ্ঞান আংশিক এবং সীমাবদ্ধ। এ দু’টি একসাথে মিলে বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। শেষ পর্যন্ত আজকের বিজ্ঞান বলছে- মহাবিশ্বের প্রকৃতি না পুরোপুরি নির্ধারণবাদী, না পুরোপুরি অনির্ণেয়। মহাবিশ্ব এমন এক জটিল নৃত্য যেখানে কিছু পদক্ষেপ পুরোপুরি পূর্বনির্ধারিত, আর কিছু পদক্ষেপ সম্ভাবনার সুরে বারবার আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। এটা আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং গভীর সত্য ও তত্ত¡ যাদের সম্মিলনে তৈরি হয়েছে বাস্তবতার সঙ্গীত।
লেখক : অর্থনীতির অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ



