গত ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জোহরান মামদানি বিপুল ভোটে বিজয় অর্জন করেছেন। নির্বাচনে মামদানি ১০.১৮ লাখ, তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী এন্ড্রু কুমো ৮.৪১ লাখ এবং রিপাবলিকান পার্টির কার্টিস স্লিওয়া ১.৪৫ লাখ ভোট পান। মামদানি কাস্টিং ভোটের ৫০.৮০ শতাংশ, এন্ড্রু কুমো ৪১.৯৯ শতাংশ এবং কার্টিস স্লিওয়া ৭.২১ শতাংশ পেয়েছেন। মামদানি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে ১.৭৮ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন। এ বিজয়ের মাধ্যমে মামদানি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নিউ ইয়র্ক সিটির ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির সর্বকনিষ্ঠ মেয়র। তার বিজয়ে বিশ্বজুড়েই আলোচনা ও পর্যালোচনা চলছে। এসবের পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। মামদানি একজন অভিবাসী ও মুসলিম। মামদানির মতো একজন অভিবাসী এবং মুসলিম যখন যুক্তরাষ্ট্র তথা পৃথিবীর সেরা, অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়, তখন তা আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়াই স্বাভাবিক। মামদানির পক্ষে নিউ ইয়র্ক জয় কিভাবে সম্ভব হলো, তা আমাদের জানা দরকার।
জোহরান মামদানির পরিচয় : জোহরান মামদানি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। বাবা মাহমুদ মামদানি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং মা মিরা নায়ার চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে তার পরিবার দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং সাত বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে চলে যায় এবং সেখানে বসবাস শুরু করে। মামদানি নিউ ইয়র্কে বেড়ে ওঠেন, সিরিয়া বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক রামা দুয়াজিকে বিয়ে করেন এবং ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পান। তিনি নিউ ইয়র্ক শহরের বাউডোউন কলেজ থেকে আফ্রিকান স্টাডিজ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যোগ দেন। বরাবরই নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার একজন হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ২০২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্ক স্টেটের অ্যাসেম্বলি সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২২ ও ২০২৪ সালে এ পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার নির্বাচিত হন। এখন নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচিত হলেন।
নিউ ইয়র্কের অবস্থান : যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিধর রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহর সারা দুনিয়ার সেরা নগরী, যার পরিচিত বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর হিসেবে নিউ ইয়র্কের আলাদা একটি ইমেজ রয়েছে। প্রায় ৯৯ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। দেশটিতে প্রায় ৪০ লাখ মুসলিম বাস করে এবং তারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.২ শতাংশ। নিউ ইয়র্কে ৮৪ লাখ মানুষের বাস, তার মধ্যে ৭.৫০ লাখ মুসলিম। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র পদে মামদানির মতো একজন অভিবাসী এবং মুসলিম যখন ভোটে বিজয়ী হয়, তখন তা চমকে ওঠার মতো খবরই বটে। নিউ ইয়র্ক হচ্ছে বহু ধর্মের, বহু বর্ণের লোকের বাসস্থান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এখানে এসেছে। নিউ ইয়র্কে বহু সংস্কৃতির লোকজন বসবাস করছে- যাদের ধর্ম ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন এবং গায়ের রঙ ও ভিন্ন। এখানে শ্বেতাঙ্গ আর অশ্বেতাঙ্গ, এশিয়ান ও আফ্রিকান, খ্রিষ্টান, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধসহ সব ধর্মের লোকজনের বসবাস।
মামদানির সফলতার কারণ : অভিবাসীর সন্তান হিসেবে মামদানি নিউ ইয়র্কে বড় হয়েছেন। তাকে সব কিছুই নিজেকে অর্জন করতে হয়েছে। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তি কিছুই ছিল না। এখানে মামদানি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। মামদানির উদার মনমানসিকতা, উন্নত রুচিবোধ ও মার্জিত ব্যবহারের কারণে তা সম্ভব হয়েছে। তিনি বরাবরই নিউ ইয়র্কবাসীর মূল সমস্যা নিয়ে এবং তা সমাধানের কথা বলেছেন। তিনি সবসময় বিভেদকে এড়িয়ে গেছেন এবং ঐক্যের কথা বলেছেন। শহরের অভিবাসীর অযৌক্তির জীবনযাত্রায় ব্যয়, বাসা ভাড়া, পরিবহন সঙ্কট ইস্যুতে মামদানির শক্ত অবস্থান আমজনতার কাছে তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি মুসলিম ডেমোক্র্যাটিক ক্লাব অব নিউ ইয়র্কের সদস্য। তিনি নিজেকে মার্কিন রাজনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করেন। তিনি গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও ফিলিস্তিনিদেরকে হত্যার বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মামদানির সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু মামদানি সবসময় জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, যে কারণে নিউ ইয়র্কের জনগণ মামদানির ধর্ম ও বর্ণ পরিচয় বিবেচনায় আনেননি; বরং তার ওপর আস্থা রেখেছেন। তিনি নিউ ইয়র্ক শহরে বসবাসরত সব ধর্মের ও সব বর্ণের মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন। ফলে নির্বাচনে সব ধর্মের ও সব বর্ণের মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। তিনি নিজেকে অভিবাসী কিংবা মুসলিম সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেননি; বরং সবার মাঝে নিজেকে জেনারেলাইজ করেছেন। তিনি নিজেকে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি না করে, সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি করেছেন। এটিই মামদানির সবচেয়ে বড় অর্জন ও সফলতার মূল চাবিকাঠি। প্রতিকূল পরিবেশে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয় এবং প্রতিকূলতাকে জয় করতে হয়, তা মামদানির জীবন থেকে শেখার আছে।
ইসলামফোবিয়া বুমেরাং হচ্ছে : যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা বিশ্বজুড়েই আজ ইসলামফোবিয়া চলছে। কিছু হলেই ইসলামকে কটাক্ষ এবং মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। মুসলমানদেরকে নজরদারি করা হচ্ছে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি বলা হচ্ছে। হিজাব পরিধানকে নিষিদ্ধ করেছে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ। হিজাব পরিধানের অপরাধে মুসলিম ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। একশ্রেণীর মানুষ ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানরা এগিয়ে যাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র পদে মুসলামানের বিজয়ে মার্কিন সমাজের কোনো ক্ষতি হবে না। সুতরাং যারা কথায় কথায় মুসলমানদের সমালোচনা করেন, মুসলমানদের উত্থানে সমাজের সমস্যার কথা বলেন তাদের উচিত এসব সঙ্কীর্ণ ও বর্ণবাদী চিন্তা পরিহার করে সমাজের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। তাহলেই বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে এবং সবর্ত্রই শান্তি বিরাজ করবে; যা সবারই কাম্য।
লেখক : প্রকৌশলী
[email protected]



