নিশ্চিত হোক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি

ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনে যেমন স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন তেমনি এর অপব্যহারের শাস্তিও কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়া জরুরি। তবেই গণমানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার প্রবণতা কম থাকে। তা না হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের অনৈতিক লোভ বাড়িয়ে তোলে।

ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত। এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেই তাকে চলতে হয়। চালাতেও হয় মানুষকে। কখনো কখনো ভুল মানুষের কারণে এই ক্ষমতা ও সম্পদ সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এ জন্যই রাষ্ট্রকে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। সম্পদ অর্জনে নিশ্চিত করতে হয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।

ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনে যেমন স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন তেমনি এর অপব্যহারের শাস্তিও কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়া জরুরি। তবেই গণমানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার প্রবণতা কম থাকে। তা না হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের অনৈতিক লোভ বাড়িয়ে তোলে।

আমাদের সমাজে বেশ কয়েক বছর ধরেই এই প্রবণতা বেশ প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। খুবই আলোচিত ও সমালোচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্যায়ভাবে পেশিশক্তির প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের মতো জঘন্য অপরাধগুলো। এটি এখন আর কেবল ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সমাজের বেশির ভাগ মানুষের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। মানুষ সহজভাবে বড়লোক হওয়ার উপায় খুঁজছে। ফলে নীতির তোয়াক্কা না করেই অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। যে যার মতো ফায়দা লুটে নিচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

মানুষ স্বাভাবিকভাবে ধারণা করছে, একটি সময় তারা টাকা দিয়ে ক্ষমতা কিনবেন। সুযোগ বুঝে সেই ক্ষমতাকে তারা কাজে লাগিয়ে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। এই ক্ষমতার জন্য তারা এখন বেহিসাবে টাকা খরচ করছে। আয়ের উৎস নিয়ে খুব একটা ভাবতে হচ্ছে না তাদের। তারা নিজেদের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে করছে। কারণ, এ দেশে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে আইনের গতিধারা যেভাবে চলে, হাই প্রোফাইলদের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচিত হয় অন্যভাবে। যদিও সংবিধান মতে, আইন সবার জন্য সমান।

আমরা অতীতে দেখেছি, একজন সামান্য কর্মচারীও মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নিজে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন, এমপি হয়েছেন, ভাইকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। সবই হয়েছে কালো টাকায়। কারণ একজন ছাপোষা কেরানির পক্ষে এভাবে দু’হাত উজাড় করে টাকা উড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। ব্যক্তি যোগ্যতা বিচারে এরা কখনোই রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসার যোগ্যতাই রাখে না। কিন্তু যা হওয়ার ছিল না, তা-ই হয়ে গেল। নির্লজ্জের মতো জাতিকে সেটিই দেখতে হলো।

এটি কোনো রূপকথার গল্প নয়। আমাদের বিদ্যমান সমাজব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি। ক্ষমতা ও অর্থকেন্দ্রিক মানুষের এই হীন চিন্তাচেতনা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কোন দিকে ধাবিত করছে? সময় হয়েছে এই অপসংস্কৃতি ঝেটিয়ে বিদায় করার। হাত গুটিয়ে আর বসে থাকলে চলবে না। যেদিকে তাকাই কেবল দুর্নীতিবাজদের লোলুপ দৃষ্টি। নিজেদের পকেট ভরিয়ে তোলার মতলববাজ সব ফন্দি। সমাজের ভালো মানুষগুলোকেও এরা দূষিত করছে। বিষিয়ে তুলছে সমাজের পরিবেশ। নিজেদের ইচ্ছার কাছে এরা মানুষকে জিস্মি করতে চায়। তারা স্বীকার করতে চায় না মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানুষের সক্রিয়তা। ক্ষমতার চেয়ারটা যদি গণমানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে, তাদের ভালো ও মন্দ লাগার বিষয়টি আমলে নিয়ে বুঝতে চায়, তাহলে এই পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া মানুষ ও সমাজ ব্যবস্থাকে আরো পরিশীলিত করতে পারে। আমরা চাই সেই ধরনের নেতৃত্ব, যারা গণমানুষের কান্নাগুলো বুঝবে। তাদের পাশে থেকে দেশ গড়বে।

ক্ষমতাকে যদি সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, অবশ্যই এটি জাতিকে একটি ভুল ম্যাসেজ দেয়। যার পরিণতি খুবই ভয়ঙ্কর। যুগের পর যুগ এটিই চলে আসছে। ক্ষমতাসীনদের একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এটিই করে চলেছেন। এখান থেকে বেরিয়ে আসার কার্যত কোনো পদক্ষেপ অতীত বছরগুলোতে লক্ষ করা যায়নি; বরং সবসময় তাদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনের প্রবণতাও বেশ বেড়ে চলেছে। ধীরে ধীরে নিয়মনীতির প্রতিও মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে, একজন দুর্নীতিবাজ সমাজসেবী যখন কালোবাজারি, চোরাকারবারি মতো সমাজবিরোধী কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, আর তার নেতৃত্বে সমাজ চলে, তখন তার সেই পাপের কালো ছায়া সমাজের ওপর পড়বে এটিই স্বাভাবিক।

চিন্তার বিষয়, দুর্নীতিগ্রস্ত এসব মানুষের সামাজিক নেটওয়ার্কও বেশ জোরালো হয়। কখনো এরা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে আইন ও প্রশাসনকে নিজেদের অধীন করে নেয়। ফলে মানুষ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে ফেলে। সমাজে ক্রাইম ছড়াতে এই দুর্নীতিবাজ চক্রটি সবসময় সুসংগঠিত থাকে। যাতে তারা নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে পারে। তাই একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠনে এই সমস্ত অপরাধীদের বিস্তার অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। তাদের সহযোগীদের ব্যাপারে কঠিন অবস্থানে থাকতে হবে রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে। নির্বাচনের সময় আমজনতাকে এটি অবশ্যই আমলে নিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থায়ও সেই ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।

নিজেদের আধিপত্য টেকাতে এরা চমৎকার কিছু কৌশল অবলম্বন করে। সবার আগে এরা টার্গেট করে ইয়াং জেনারেশন, বিশেষ করে বেকার যুবসমাজকে। কাজ দেয়ার নামে যাদেরকে খুব সহজেই দলে ভেড়ানো যায়। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের শতভাগ কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা থাকা দরকার। যুবসমাজকে অনিরাপদ অবস্থার দিকে ছেড়ে দিয়ে কখনোই সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্রের কথা ভাবা সম্ভব নয়।

তৃতীয় শ্রেণীর মেধার অধিকারী সশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষগুলো যখন নীতিবহির্ভূত পেশায় জড়িয়ে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন সৎ মানুষগুলোর এসব তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কারণ সমাজের একটি বড় অংশ এই অন্যায়ের প্রশ্রয় দেয়ার জন্য তার পাশে দাঁড়িয়ে যায়। ন্যায়-অন্যায় বোধের স্বাভাবিক প্রতিবাদী চেতনা এখন অনেকেরই নেই। আমি যাকে সাপোর্ট করছি মানুষ হিসেবে সে কেমন, তার কর্মগুলো সমাজের জন্য কতটা উপকারী এসব এখন আর ভাবছে না কেউ। টাকা আছে যার, মানুষ তার পাশে ভিড় করছে। একজন লম্পট দুশ্চরিত্রকেও নিজেদের নেতা মানতে অসুবিধে নেই অনেকের। একটা চোর, একজন গুণ্ডা-বদমাশকেও মানুষ নেতৃত্বের আসনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, তার টাকা আছে। অনেকে টাকার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে। টাকার গোলাম বানিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। তখন সেই সমাজের নীতিবান অবহেলিত তরুণরা আফসোস ছাড়া আর কিই বা করতে পারে। তখন তারা পড়ে পড়ে নিজেদের অসহায়ত্বের জন্য নিজেদের ধিক্কার জানায়। জীবনের তাগিদে এক সময় সে নিজেও ওই দিকেই ছুটতে থাকে।

যে মানুষটি চরম অদক্ষ। কোনো ক্রিয়েটিভ চিন্তা নেই। আপাদমস্তক দুর্নীতিতে জড়ানো, সামান্য সময়ের ব্যবধানে তিনি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। চোখ ঝলসে যায় মানুষের এসব দেখে। কী আলাদিনের চেরাগ তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমাজের উঁচু তলায়? শুধু এইটুকু যে, কোনো এক প্রভাবশালী মানুষের আশীর্বাদ পড়েছে তার ওপর, যার আছে শুধু শয়তানি ও বদমায়েশির দক্ষতা। চুরির বৈধতার জন্য কাজের সনদ পেয়েছেন তিনি। তার কাজের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার কোনো বালাই নেই। কী আজব দেশ! মন্ত্রীর চেয়ে মন্ত্রীর চামচার জোর বেশি। এভাবেই আশাহত হয়ে থাকব আর কতদিন? দেশটা ভালো থাকুক। ভালো থাকুক এ দেশের মানুষ। সেই রকম একটি সুপরিকল্পিত নীতির দিকে এগিয়ে চলাই হবে সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত। যাতে সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে রাষ্ট্র পরিচালনায়।

আমাদের সমাজব্যবস্থায় নেতৃত্বের জায়গায় তাদের অংশগ্রহণ খুবই অপরিহার্য, যাদের সমাজকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো মানবিক ও সামাজিক গুণাবলি রয়েছে। রয়েছে ভালো-মন্দের বিচারিক ক্ষমতা। উন্মাষিকতা প্রকাশ করে সমাজ থেকে ভালো মানুষদের পিছিয়ে পড়া, আজকের এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ। এগিয়ে আসতে হবে সাহস নিয়ে। এ দেশের জন্য, এ দেশের মানুষের জন্য।

যাকে আমরা ভালো মানুষ বলে ভাবি, তারা এখন সামাজিক কাজে এগিয়ে আসতে চান না, কারণ তারা সামাজিকভাবে অবমূল্যায়নের শিকার। নিজেদের অধিকার নিজেদের ছিনিয়ে আনতে হবে। আর কতকাল ভালো মানুষগুলো পড়ে পড়ে মার খাবে। অসৎকে না বলার সময় এসেছে। একবার শক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ান, আপনার চেয়ে সাহসী আর কেউ হবে না।

লেখক : সাহিত্যিক ও গবেষক