আকাশযুদ্ধের ইতিবৃত্ত

আজকের আকাশযুদ্ধ সমরাস্ত্রের প্রগতি সূক্ষ্মতার উচ্চতায় উঠতে চেয়েছে; শল্য সূক্ষ্মতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে চেয়েছে অথচ ঝাঁকে ঝাঁকে প্রেরিত পাখি নিক্ষিপ্ত অতিক্ষুদ্র কঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ যেমন ছিল সুতীব্র, তেমনি নির্ভুলতায় ছিল স্নায়ু-শল্য-সূক্ষ্ম। যদিও ঐশ্বরিক বিমানবাহিনীর সূক্ষ্মতা কখনো স্পর্শ করতে পারবে না মানবীয় নিশানা, তবু ভবিষ্যতের আকাশ হতে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত সমরাস্ত্রে সেটি শিক্ষণীয়।

এয়ার কমোডর মোহাম্মদ মুশতাকুর রহমান

১৯০৩ সালে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় উইলবার ও অরভিল রাইট যখন প্রথম আকাশযান তৈরি করলেন, সহস্রাব্দের এক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক অধিকীর্তিতে তাদের মনে কী জেগেছিল? ১৯১২ সালে উইলবার মারা গেলেও অরভিল রাইট দু’টি বিশ্বযুদ্ধ দেখে ১৯৪৮ সালে মারা যান। ১৯১৭ সালের ২১ জুন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষার্ধে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা দু’ভাই মিলে যখন প্রথম আকাশযান বানালাম ও উড়লাম, আমরা ভেবেছিলাম আমরা বোধ হয় এমন কিছু আবিষ্কার করেছি যা দ্বারা ভবিষ্যতে মানবসভ্যতায় যুদ্ধ-বিবাদ শেষ হয়ে যাবে।’ কিন্তু শৈশবে আকাশযুদ্ধ তার মুন্সিয়ানা নিয়ে উপস্থিত হলো; ১৯১১ সালের ২৬ অক্টোবর ইতালির বৈমানিকরা উসমানীয় সাম্রাজ্যের ত্রিপোলিতে (লিবিয়া) আক্রমণ করল আকাশ থেকে বোমা ফেলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একপর্যায়ে ব্রিটিশ এমিয়েন্স-স্পাইডার আর জার্মান জেপলিন গোথা বিমান যুদ্ধ শুরু করল; বিশেষ করে ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে জার্মান গোথা যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী লন্ডনে আক্রমণ চালাল, তখন ‘বিশ্বসভ্যতার’ টনক নড়ল। মানবসভ্যতায় আকাশযান যখন এক অভিনব অবিশ্বাস্য বিষয়, তখন অনেকটা স্বপ্নদূতের মতো মর্যাদা পাওয়া শুরু করল বৈমানিকরা। শুধু যুদ্ধবিমান পরিচালনা নয়, নানা কসরত ও কৌশলের উদ্ভাবনও তাদের অবদান। আকাশযুদ্ধের ইতিহাসের এক বিরাট অংশজুড়ে থাকে আকাশকৌশল, কসরত ও উড্ডয়নশৈলীর বিবর্তন।

যুদ্ধকলায় আকাশযানের সৌকর্য হচ্ছে, এটি যেকোনো দ্বিমাত্রিক যুদ্ধবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম। ১৯৩৯ সালে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে পূর্বপ্রান্তে যুদ্ধের খাতা খুলেছিলেন, ‘অবাধ্য’ পোল্যান্ড সেনাবাহিনীকে প্রথমে স্বল্পমাত্রার যুদ্ধবিমানের ত্বরিত ও ব্যাপক বোমাবর্ষণে গুঁড়িয়ে দিয়ে।

ইঙ্গ-মার্কিন কৌশলগত আকাশ আক্রমণে জার্মানির রুঢ়, হামবুর্গ আর বার্লিন ধ্বংসস্তূপ হয়েছিল ১৯৪৩-৪৪ সালে। আকাশ আক্রমণের কলঙ্কসমেত হিরোশিমা নাগাসাকির লাখ লাখ জীবন ধ্বংসের অবর্ণনীয় নেতিবাচক ফল নিয়ে ১৯৪৫ সালে প্রথম ও একমাত্র আণবিক বোমা ফেলে জাপানে আক্রমণ করল মার্কিনিরা। যুদ্ধ অবশ্য থেমে গেল; বিশ্বসভ্যতার সর্বশেষ মহাযুদ্ধ থামানোর এটিই কি ছিল সর্বোত্তম পন্থা?

কিন্তু যুদ্ধাকাশ-সহিংসতার এ আখ্যান এত সহজ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভূমিতে সেনাবাহিনীকে সাহায্যের পাশাপাশি প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরে আকাশশক্তি তার অনুপম শক্তিমত্তা দেখিয়েছে। ১৯৪১ সালে জাপান পার্লহারবার আক্রমণ করে যে যুদ্ধ শুরু করে; বছর চারেক সব প্রশান্ত মহাসাগরকে অশান্ত করে রেখেছিল এ আকাশবাহিনী। ১৯৫০-এ, কোরিয়া যুদ্ধারম্ভ প্রাক্কালে আকাশযানের সর্বোত্তম বিপ্লবটি ঘটল। আবিষ্কৃত হলো জেট ইঞ্জিন। আরেকটি অনবদ্য বিপ্লব ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ ঘনিষ্ঠ করে দিলো দ্বিমাত্রিক সেনাবাহিনীর সাথে, হেলিকপ্টারের আবিষ্কার হলো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পক্ষত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা বৈমানিকরা, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীজ বপন করেন, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ জন্ম নিলো ‘কিলো ফাইট’। পাকিস্তান পক্ষত্যাগী বিমানবাহিনীর সুদক্ষ কারিগর প্রকৌশলীরা নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের দন্তমূলে বিষ তৈরি করলেন। নবউদ্যোগী বাঙালি বৈমানিকরা সেই নিরস্ত্র আকাশযানকে সশস্ত্র যুদ্ধবিমানে রূপান্তর করে ৩ ও ৪ ডিসেম্বরের গভীর রজনীর আঁধারের আলোকযাত্রী হলেন; স্বাধীনতার আরেক সূর্য উদিত হলো।

অন্যান্য সশস্ত্রবাহিনীর তুলনায় যে অভাবিত বৈশিষ্ট্য দ্বারা আকাশ শক্তি ও বিমানবাহিনী বিভূষিত তার প্রধানটি সম্ভবত গতি। গত অর্ধশতাব্দীতে গতি ও ত্বরার এমন বিকাশ দেখা গেছে যার স্বপ্ন আড়াই হাজার বছর আগে, আকাশবাহিনীর ধারণা ছাড়াই, সুবিখ্যাত চীনা সমরকৌশলী সান ঝু দেখেছিলেন, ‘যুদ্ধে যেটি সবচেয়ে মূল্যবান তা হলো- দ্রুত বিজয়, প্রলম্বিত যুদ্ধ নয়’। ১৯৬৭ সালের বিশ্ব ইতিহাসের দ্রুততম বিজয়ের নজির রাখে ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, যা আসলে মাত্র ছয় ঘণ্টায় ইসরাইলি বিমানবাহিনী সেরে ফেলেছিল। দুই হাজার বছরের ফিলিস্তিনের মানচিত্র বদলে তাদের রাষ্ট্রহীন করে দেয়। সুদূর দক্ষিণ ইসরাইল থেকে জর্দান-সৌদি আরব পেরিয়ে একগুচ্ছ এফ-১৫ ও এফ-১৬ সুদূর বাগদাদের নিকটবর্তী আল তুয়াইতা (ওসিরাক) পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করে ১৯৮১ সালের ৭ জুনের কয়েক মিনিটের কর্মযজ্ঞে। কৌশলগত আনবিক শক্তি সঞ্চয়ের আশা দূরপরাহত হয়ে গেল এ বিপ্লবী আরব দেশটির। আকাশমাধ্যমে তড়িৎকল্প ক্রীড়াকৌশলের সাথে যুদ্ধবিমানের মিতালি পাতানো এক অভূতপূর্ব আকাশ তড়িৎযুদ্ধ দিয়ে ১৯৮২ সালে দুদিনে সিরিয়ার বেক্কা মালভূমিতে আক্রমণ চালায় আকাশশক্তি; সুনসান করে দেয় সিরিয়ার গোলান মালভূমির ভবিষ্যৎ।

পাকিস্তান থেকে ইরাকি বিমানবাহিনীতে প্রেষণে থাকা বাঙালি যুদ্ধ বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম; তিনি জবাব দিয়েছিলেন ইসরাইলের বিমানবাহিনীর। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন, ইসরাইলি আকাশ লঙ্কাকাণ্ডে যেদিন আঁধারে ঢেকে যায় আরব, সেদিন পশ্চিমপ্রান্তে (মিসর) সফল ইসরাইলকে পূর্বপ্রান্তে (ট্রান্স জর্দান) নাকাল করে ছেড়েছিলেন আকাশে আকাশযুদ্ধের শুভনিনাদ বাজানো এ বাঙালি যুদ্ধ বৈমানিক। ইসরাইল বিমানবাহিনীর জঙ্গি আক্রমণকারী চারটি যুদ্ধবিমান মিস্টের (ফ্রান্স নির্মিত) একাই ধাওয়া করলেন, আকাশ থেকে আকাশে ছোড়া গোলা-ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করে দুটো তৎক্ষণাৎ ভূপাতিত করলেন সাইফুল আজম।

১৯৮৬ সালে ১২-১৫ মিনিটের আক্রমণ চালিয়ে (অপারেশন এলদোরাদো কেনিয়ন) মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনীর আকাশয্দ্ধু বহর লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি ও মূল শহর বেনগাজিতে ত্রাস সৃষ্টি করে। এতে সিদ্রা উপসাগর জঙ্গি বিমানের কসরতের এলাকায় পরিণত হয়। ইরাক আক্রমণে (গালফ ওয়ার ১৯৯১) বিমানবাহিনী, আকাশশক্তি ও আকাশযুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাত ও প্রত্যুষের মাঝামাঝি সময়ে ইঙ্গ-মার্কিন ও সৌদি যুদ্ধবিমানের আক্রমণে তাতিয়ে উঠে বাগদাদ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আকাশযুদ্ধে ও আকাশশক্তির বিকাশে এক অপরিহার্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় রাডারব্যবস্থা। এ উপমহাদেশের পাক-ভারত যুদ্ধে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও রাডার তার সুস্পষ্ট প্রভাব রেখেছে।

নব্বইয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত তুলনামূলক দুর্বল পাকিস্তানের গোছানো আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান শক্তিধর ভারতকে বরাবর বিব্রত ও নাকাল করেছে।

২০১৯-এ পুলওয়ামা ঘটনা-পরবর্তী ও ২০২৫ এ পহেলগাম সন্ত্রাস-পরবর্তী আকাশযুদ্ধে শক্তিধর আগ্রাসী ভারতেরও নামাঙ্কিত রাফায়েল সম-আধুনিক যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত আকাশ সমরাস্ত্র জেহাল করার কৃতিত্ব তুলনামূলক ক্ষুদ্র পরিসরের কিন্তু আকাশ প্রযুক্তি ও যুদ্ধ কলাকৌশলের খেলায় এগিয়ে থাকা পাকিস্তানের। অনাগ্রাসী ও আত্মরক্ষাপন্থী পৃথিবীর সব ‘প্রলেতেরিয়ান’ বিমানবাহিনী এ আকাশ পর্যবেক্ষণের ও প্রতিরক্ষার রাডারে সজ্জিত।

আকাশের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যেকোনো যুদ্ধে জিততে পারবে না- প্রায় শতবর্ষ আগে বলে গেছেন আকাশ যুদ্ধতত্ত্বের গুরু রাজকীয় বিমানবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা স্যার মার্শাল অব দ্য এয়ারফোর্স হুগো ট্রেন্ডচেড। শক্তিধরের আগ্রাসনও ধূলিস্যাৎ হয়েছে আকাশ নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্যহীনতায়। আবার জনপ্রিয় জনযুদ্ধও সাফল্য পায়নি শত্রুর আকাশ নিয়ন্ত্রণের মারফতিতে।

আজকের আকাশযুদ্ধ সমরাস্ত্রের প্রগতি সূক্ষ্মতার উচ্চতায় উঠতে চেয়েছে; শল্য সূক্ষ্মতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে চেয়েছে অথচ ঝাঁকে ঝাঁকে প্রেরিত পাখি নিক্ষিপ্ত অতিক্ষুদ্র কঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ যেমন ছিল সুতীব্র, তেমনি নির্ভুলতায় ছিল স্নায়ু-শল্য-সূক্ষ্ম। যদিও ঐশ্বরিক বিমানবাহিনীর সূক্ষ্মতা কখনো স্পর্শ করতে পারবে না মানবীয় নিশানা, তবু ভবিষ্যতের আকাশ হতে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত সমরাস্ত্রে সেটি শিক্ষণীয়।

উপরোল্লিখিত এত সাফল্যের সাতকাহন গাইলেও আকাশশক্তির ব্যর্থতার খতিয়ানও বিরল নয়। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন মাত্র ছয় ঘণ্টায় শক্তিধর চতুর্দিক পরিবেষ্টনকারী সুবিস্তৃত আরব বিশ্বকে কপর্দকশূন্য করা ইসরাইলি বিমান বহর ২০০৬ সালে ঘরের উঠানে দক্ষিণ লেবাননে আকাশশক্তিহীন (কতিপয় কাতিউশা রকেট যাদের সঙ্গি) হিজবুল্লাহ বাহিনীকে ৩৪ দিনেও সামান্যতম কাবু করতে পারেনি। অতীতেও রুশ যৌথবাহিনী, মিগ-২৩, মিগ-২৫ সংবলিত আর অ্যাটাক হেলিকপ্টার বহর নিয়ে হাতে গুনতি আফগান মুজাহিদদের কাছে বছরের পর বছর নাকাল হয়েছে। গণহত্যা চালিয়েছে আকাশশক্তির প্রমত্ততায়, কিন্তু যুদ্ধে হেরে গেছে। বিজয় কি শুধু শক্তি ও কৌশল দিয়ে? বিজয়ের প্রকৃত মালিকানা আল্লাহর হাতে। ‘আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্রদল বিজয়ী হয়েছে কত বৃহৎ দলের মোকাবেলায়।’ (আল কুরআন-২ : ২৪৯ শেষাংশ)

লেখক : ডিন, অ্যাভিয়েশন ব্যবস্থাপনা অনুষদ, অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়