এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে ২০২৫ সালের ১ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন পুনর্বহাল করেছেন। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব মাওলানা সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির নেতারা, সম্মিলিত ইসলামী জোট এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নামক সংগঠনের সদস্যরা একত্র হয়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের জন্য একটি রিট আবেদন দায়ের করার পরিপ্রেক্ষিতে এই মামলার যাত্রা শুরু হয়। মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে এটি হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারকের একটি বিশেষ বেঞ্চে শুনানি করা হয়। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেন। ফলে ২০১৩ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০২৫ সালের ১ জুন পর্যন্ত জামায়াত নিবন্ধনবিহীন অবস্থায় থাকে। তবে, এ সময়ে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এই সিদ্ধান্তের বাস্তব প্রভাব খুব একটা ছিল না। জামায়াতের নিবন্ধন পুনর্বহালের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে ন্যায়বিচার, রাজনীতি ও গণতন্ত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চের প্রদত্ত রায় সর্বসম্মত ছিল না। বিশেষ বেঞ্চের তিন বিচারক সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ পেলেও তাদের মতামত সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন ছিল। জ্যেষ্ঠ বিচারক এম. মোয়াজ্জেম হোসেন ন্যায়বিচার ও সততার জন্য সবার কাছে সম্মানিত ছিলেন। তিনি আইনি বিধানাবলির মধ্যে থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত হতে দেননি। তার বিচারের রায়ে তিনি রিট পিটিশন খারিজ করে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেন। তবে, অন্য দুই বিচারক ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা রিট পিটিশন মঞ্জুর করে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের নির্দেশ দেন। এই দুই বিচারক তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এম. এনায়েতুর রহিম ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই পদত্যাগ করেন। অন্য বিচারক ড. কাজী রেজাউল হক বছরের পর বছর ধরে বিচারিক কার্যক্রমের বাইরে ছিলেন। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের কারণে ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকে তাকে কোনো বিচারিক দায়িত্ব দেয়া হয়নি। তিনিও ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে পদত্যাগ করেন। এই বেঞ্চের একমাত্র বিচারক মোয়াজ্জেম হোসেন, তার পূর্ণ মেয়াদ প্রশ্নাতীতভাবে সম্পন্ন করেছেন এবং তার প্রদত্ত রায় শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগে বহাল থাকে।
হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চের শুনানিতে মাওলানা সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী ও অন্যান্য আবেদনকারীর পক্ষে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর উপস্থিত ছিলেন। তারা এই মামলাটি জনস্বার্থ মোকদ্দমা (Public Interest Litigation) হিসেবে উল্লেখ করে দাবি করেছিলেন যে, এটি জনগণের আইনি অধিকার রক্ষার জন্য দায়ের করা হয়েছে। তবে শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল যে, আবেদনটি জনস্বার্থ মামলার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি শর্ত পূরণ করেনি। আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি শুধুমাত্র তখনই রিট আবেদন দায়ের করতে পারেন, যখন তার ব্যক্তিগত আইনি অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, অথবা তিনি জনস্বার্থে জনগণের আইনগত অধিকার রক্ষায় কাজ করেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে, আবেদনকারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য আইনি না হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। তারা প্রমাণ করতে পারেননি যে জামায়াতের নিবন্ধনের কারণে তাদের ব্যক্তিগতভাবে কোনো আইনি ক্ষতি হয়েছে। তারা এটাও ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে, কিভাবে জামায়াতের রাজনৈতিক নিবন্ধন সাধারণ জনগণের আইনি অধিকার লঙ্ঘন করেছে। মামলাটির সহ-আবেদনকারী ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’-এর সদস্যরাও নিজেদের বা জনগণের অধিকার আইনিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। তাদের প্রধান যুক্তি ছিল যে, জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করায় তারা অসন্তুষ্ট। কিন্তু অসন্তুষ্টি রিট পিটিশন দায়েরের জন্য বৈধ কোনো ভিত্তি নয়। রিট আবেদনকারীরা জামায়াতকে নিবন্ধন দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের কোনো আইনগত ভুলও চিহ্নিত করতে পারেননি। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জোরালোভাবে যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, পিটিশনটি আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা খারিজ করা উচিত। এভাবেই সব যুক্তি সত্ত্বেও, হাইকোর্ট বিভাগ ২:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আবেদনকারীদের পক্ষে রায় দিয়ে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেন।
২০১৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করলে, দলটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করে। এই আপিলের শুনানি শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালের নভেম্বরে নির্ধারিত হয়। তবে, জামায়াতের আইনজীবী দল কৌশলগত কারণে শুনানি মুলতবির সিদ্ধান্ত নেন। তাদের মতে, সে সময়ের আপিল বিভাগের বেঞ্চ একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ বা নিরপেক্ষ শুনানি প্রদান করতে সক্ষম হবে না। আপিল বিভাগে তখনকার বিচারকদের মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ করছিলেন এবং সেখানে তারা জামায়াতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন ও দলটিকে যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত বলে অভিহিত করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে জামায়াতের আইনি দল আশঙ্কা করেছিল যে, শুনানি চললে আদালত শুধু আইনি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং দলটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করতে পারে। এই ঝুঁকি এড়াতে জামায়াতের আইনজীবীরা মামলাটির মুলতবি চান, যদিও তারা জানতেন যে আদালত এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আপিল খারিজ করতে পারেন। ফলে, ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আইনজীবীরা আদালতের কাছে মুলতবির আবেদন করেন। আদালত আবেদন নাকচ করে দেন এবং এর ফলস্বরূপ, কোনো শুনানি ছাড়াই জামায়াতের আপিল খারিজ হয়ে যায়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। এর অব্যবহিত পরই ওই মাসেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বেশির ভাগ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। তারপর আপিল বিভাগের একটি নতুন বেঞ্চ গঠন করা হয়। পূর্বেকার শুনানি ছাড়াই খারিজ হয়ে যাওয়া আপিল ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে পুনর্বহাল করা হয়। তিন দিন ধরে মামলাটির শুনানি হয়। মজার বিষয় হলো, জুলাই বিপ্লবের ঘটনার পর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী ও অন্যান্য রিট আবেদনকারীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনকারী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর আদালতে উপস্থিত হননি। তার চেম্বার থেকে কেউই মাওলানা চাঁদপুরী বা অন্য আবেদনকারীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে আসেননি। মাওলানা চাঁদপুরী বা ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’-এর কোনো সদস্যই আপিল বিভাগে তাদের পক্ষে নতুন কোনো আইনজীবী নিয়োগেরও ব্যবস্থা করেননি। মামলাকার্যক্রমে তাদের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে তারা আর মামলাটি চালিয়ে যেতে আগ্রহী নন। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, তাদের মূল রিট আবেদনটি আইনি ভিত্তির ওপর নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। তারা কেবল আওয়ামী লীগ শাসনামলে সক্রিয়ভাবে মামলাটি পরিচালনা করেছিল, যখন অনেক বিচারিক বেঞ্চ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গিয়ে বিচারব্যবস্থা যখন নিরপেক্ষ হলো, তখন তারা মামলা থেকে সরে দাঁড়ান, কারণ তারা জানতেন যে তাদের মামলার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
২০২৫ সালের ১ জুন আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে জামায়াতে ইসলামীর আপিল মঞ্জুর করেন এবং দলটির রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পুনর্বহাল করেন। আদালত রায় প্রদান করেন যে, জামায়াতের নিবন্ধনের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিট পিটিশনটি আইনগতভাবে বৈধ ছিল না। এটি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক এম. এনায়েতুর রহিম ও ড. কাজী রেজাউল হকের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়কে প্রত্যাখ্যান করে জ্যেষ্ঠ বিচারক এম. মোয়াজ্জেম হোসেনের পূর্বের সংখ্যালঘিষ্ঠ রায়কে গ্রহণ করে।
‘জামায়াত নিবন্ধন’ মামলাটি একটি স্বাধীন ও রাজনীতি-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার শক্তিশালী অনুস্মারক। এটি প্রমাণ করে যে, কিভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়ে, শুধুমাত্র আইনি বিধানের ভিত্তিতে হওয়া উচিত— প্রচলিত রাজনৈতিক আবহ বা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেনি, বরং নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বহাল রাখার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিল এবং এর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছিল। তবে নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত এসেছিল হাইকোর্ট বিভাগ থেকে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়টি আইনি যুক্তির চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় কোনো আইনি নীতির ভিত্তিতে ছিল না, কিন্তু এর ফলাফল তখনকার ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছার সাথে স্পষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আপিল বিভাগের পরর্বর্তী সিদ্ধান্ত এই ভুল সংশোধন করতে সাহায্য করলেও মামলাটি সামগ্রিকভাবে দেখিয়েছে যে, আদালত যখন রাজনৈতিক এজেন্ডা দ্বারা প্রভাবিত হয়, ন্যায়বিচার তখন লুণ্ঠিত হয়।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি