সঙ্কটের মূলে

আমাদের মতো দেশে, যেখানে নানা সমস্যা বিদ্যমান, সেখানে এই মূল ইস্যু হতে পারে অদক্ষতা ও দুর্নীতি। এটি হতে পারে সামাজিক সঙ্কটের গভীরে প্রোথিত বৈষম্য। একটি রাজনৈতিক সঙ্কটে তা হতে পারে মূল জাতীয় ইস্যু নিয়ে মতবিরোধ বা জনগণের আস্থার অভাব।

সঙ্কটের মূল সুর বলতে একটি জটিল পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় দিক বোঝানো হয়। এটি সেই ইস্যু, যার চার পাশে সবকিছু আবর্তিত হয়। যার সমাধান না করা পর্যন্ত সঙ্কট নিরসন সম্ভব হয় না। এটি হচ্ছে সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু, যেখান থেকে সমস্যার জন্ম নেয় বা যেখানে সমাধান নিহিত রয়েছে। প্রকৃত সমস্যাটি কোথায়, তা শনাক্ত করা গেলে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। এটি সেই মৌলিক বিষয়, যা পুরো সঙ্কটের ভিত্তি তৈরি করে। কখনো কখনো এটি এমন একটি নির্ধারক মুহূর্ত নির্দেশ করে, যেখানে সঠিক সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে।

ব্যক্তি, পরিবার বা জাতীয় জীবনে সঙ্কট নিরসনে এ ‘মূল ইস্যু’ চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি চিহ্নিত করতে পারলে প্রচেষ্টা সঠিক খাতে প্রবাহিত করা যায় এবং দ্রুত ও কার্যকর সমাধান সম্ভব হয়। সঙ্কটের মূল ইস্যু বা কেন্দ্রীয় সমস্যাটি নির্ণয় করতে হলে, তা বিশ্লেষণ করে গভীরভাবে বোঝার প্রয়োজন পড়ে।

আমাদের মতো দেশে, যেখানে নানা সমস্যা বিদ্যমান, সেখানে এই মূল ইস্যু হতে পারে অদক্ষতা ও দুর্নীতি। এটি হতে পারে সামাজিক সঙ্কটের গভীরে প্রোথিত বৈষম্য। একটি রাজনৈতিক সঙ্কটে তা হতে পারে মূল জাতীয় ইস্যু নিয়ে মতবিরোধ বা জনগণের আস্থার অভাব।

স্বাধীনতার পর থেকে আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নানা সঙ্কটে ভুগছি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এই সঙ্কটের মূল সুর হিসেবে জাতীয় ঐক্যের অভাবকে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শুরুর সময়ে সরকার দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্ত করার পথ বেছে নেয়, যার পেছনে ছিল গোপন অভিসন্ধি। এর ফলে ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিব সরকারের পতন পর্যন্ত মাত্র চার বছরের মধ্যে দেশ অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ সৌভাগ্যক্রমে পায় জিয়াউর রহমানের মতো একজন দূরদর্শী ও দৃঢ় নেতৃত্বসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে একটি আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেন। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ধারণাটি তার একটি ঐতিহাসিক কীর্তি, যা বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রণীত ও প্রবর্তিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। সে অনুযায়ী কার্যকর নীতি গ্রহণ করে সফলতার সাথে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন।

জিয়াউর রহমানের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক অবদান ছিল, দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা, যা শেখ মুজিবুর রহমান বিলুপ্ত করেছিলেন, যদিও তিনি নিজেকে একজন গণতন্ত্রী বলে দাবি করতেন। জিয়া আওয়ামী লীগকেও নতুন করে রাজনীতি শুরু করার সুযোগ দেন। এ ছাড়া বাম ও ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ইসলামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রেও অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। এর ফলে দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে ওঠে, যেখানে সব রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে গণতান্ত্রিক চর্চায় অংশ নিতে পারে। অতীতের ব্যর্থতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সংসদে বিরোধী দল হিসেবে জায়গা করে নেয়। এটি ছিল এক সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের দূরদর্শী পদক্ষেপ।

জিয়াউর রহমান ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল সুরটি ধরতে পেরেছিলেন। একই সাথে একটি সুশৃঙ্খল, ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি রাজনৈতিক সঙ্কটের মুহূর্তে একটি সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ফল।

জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে জাতীয় ঐক্য তেমন হুমকির মুখে পড়েনি। কিন্তু ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তার পিতার নীতি অনুসরণ করে জাতিকে চিরতরে বিভক্ত করতে পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নেন। তিনি ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তা ও আশীর্বাদে একধরনের ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু চব্বিশের জুলাই বিপ্লব শেখ হাসিনার শাসনের অবসান ঘটায়। পিতার মতো তাকেও ক্ষমতা হারাতে হয় অবমাননাকরভাবে। শেখ হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। তিনি পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

বাংলাদেশের নিরীহ জনগণ বরাবর ভারতের আধিপত্যবাদী রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়েছে। জনগণ এখন সঙ্কটের মূল সুর, জাতীয় ঐক্যের অভাব, সঠিকভাবে বুঝতে শিখেছেন। দীর্ঘ দিন ধরে ভারত ছিল আমাদের জাতীয় ঐক্যে বিভক্তি সৃষ্টির অন্যতম কারিগর। কিন্তু চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের ঐক্যের মধ্য দিয়ে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় এখন আবার ধ্বংসের মুখে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো এ ‘মূল সুর’ বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জুলাই বিপ্লবের সুফল হাতছাড়া হয়ে যাবে।

ইতোমধ্যে জাতি একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের সুযোগ হারিয়েছে। এটি উপলব্ধি করতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিএনপি একটি ঐতিহ্যবাহী দল হওয়ায় নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির চিন্তাধারার সাথে সমন্বয় করা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। এটি প্রত্যাশা করাও বাস্তবসম্মত নয়। এ দিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কিছু রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় দিলেও, দেশের সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী শক্তি বিএনপির সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে, অনেকের মতে- যা দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপির দায়ও অস্বীকারের উপায় নেই। দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলে জন-আকাক্সক্ষার সংস্কার কার্যক্রমকে গৌন করে ফেলার জন্য অনেকেই বিএনপিকে দায়ী করেন। আগামী দিনের রাজনীতিতে জামায়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে দলটির ভূমিকাও অপরিহার্য হবে নিঃসন্দেহে। এ জন্য আরো একটু অপেক্ষা করা উচিত বলে আমাদের ধারণা। তবে জামায়াতের কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হয় যে, তারা এখনই সে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।

এখন বিএনপির উচিত, একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করা। জাতি প্রত্যাশা করে, তারা যেন দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়ে দল পরিচালনা করে। ভুল করার কোনো সুযোগ তাদের সামনে নেই।

এনসিপি, জন্মলগ্ন থেকে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রু দু’দিক থেকে চাপে রয়েছে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও সহনশীলতার ঘাটতি রয়েছে, যা রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদাবাজির অভিযোগ তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিএনপিরও অনেকটাই সুনামহানি ঘটিয়েছে। এনসিপির উচিত সরকারের ওপর নির্ভর না করে স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করা। গোপালগঞ্জ ও কক্সবাজারের ঘটনায় তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা তরুণ, কিন্তু এখনো সম্মোহনী শক্তির কোনো নেতা হিসেবে তাদের কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি, যা একটি রাজনৈতিক দলের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। জাসদের ব্যর্থতা ও বিএনপির সাফল্য এর প্রমাণ। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়াও নিজেকে একজন সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী নেত্রী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। বিএনপিকে দেশের সবচেয়ে বড় ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয়তাবাদী শক্তিতে পরিণত করেছেন।

রাজনীতিতে কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই, এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতার খেলা। এনসিপি নেতৃত্বের উচিত এখন রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল সুর অনুধাবন করা। সেই সাথে এমন কোনো কার্যক্রম হাতে না নেয়া, যা বাস্তবায়ন তাদের জন্য কঠিন হতে পারে। জামায়াতের সামনে জাতীয় ঐক্য গঠনে বিশাল ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে, জাতি সে দিকে তাকিয়ে আছে। আর প্রায় সবারই ধারণা, বিএনপি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে আসবে। অতীতে তারা যা পেরেছিল, এবারো তাদের তা প্রমাণ করতে হবে।

আমাদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে, চক্রান্তকারীদের বিষয়ে। তারা এখনো সক্রিয়। পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে ফের মাথা তুলতে সহায়তা করছে চক্রান্তকারীরা। এ মুহূর্তে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক সব শক্তিকে, জুলাই বিপ্লবের অংশীজনদের এখন আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, সবধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে জাতির ইস্পাত কঠিন ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। এখন সময় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সবাইকে একযোগে কাজ করার।