আজ জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের স্মারক দিবস। সেনাবাহিনীর একটি বিপথগামী অংশের প্রতিবিপ্লব ঠেকিয়ে দিতে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল সিপাহি-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধ। এটিই ইতিহাসে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে বরিত হয়েছে।
এই বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের পর আবারও আধিপত্যবাদী অংশের প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে সংঘটিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবে দেশ আবার রাহুমুক্ত হয়। দেশের প্রতিটি সেক্টরে তৈরি হয় বন্ধনমুক্তির জাগরণ। সব আধিপত্যবাদের নিগড় ভেঙে স্বদেশ ফিরে আসে নিজের ধারায়, স্বাধীনতা ও মুক্তির কক্ষপথে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রক্তাক্ত পটপরিবর্তন, ৩ নভেম্বর মিলিটারি ক্যু এবং ৭ নভেম্বরের কাউন্টার ক্যু ও সিপাহি-জনতার বিপ্লবের প্রেক্ষিত উপলব্ধি করতে হলে আমাদের এর আগের ঘটনা পরম্পরা জানা দরকার।
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের তাৎপর্য ও প্রভাব বর্ণনার আগে তদানীন্তন রাজনীতির অন্দর-বাহিরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জানা জরুরি।
স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীনদের অপশাসন ও লুণ্ঠনে দেশে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে। বন্যায় দেশে ব্যাপক ফসলহানি হওয়ায় চুয়াত্তরে দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেয়। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ায় সারা দেশে একটা গুমোট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ সময় গোপন চরমপন্থী দলের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে আতঙ্কগ্রস্ত সরকার চরম ব্যবস্থা নেয় এবং দেশে হত্যা নিপীড়নের তাণ্ডব চালায়। সেই সাথে কায়েম করা হয় একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল।
বাকশালের একদলীয় শাসনে জনজীবন পিষ্ট হতে থাকে। আর সব মানুষের মতন এর প্রভাব সেনাবাহিনীতেও পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটেই ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন। কিছু বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তার হাতে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন।
১৫ আগস্টের ঘটনার পর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড বা নির্দেশ সূত্র ফিরিয়ে আনার কথা বলে ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে বা ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটান এবং নিজেই আবার চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন করে নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন।
সমঝোতার অংশ হিসেবে খন্দকার মোশতাক ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপদে দেশ ত্যাগ করার সুযোগ করে দেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং ৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করে নিজে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৩ নভেম্বর ভারতের মদদে জেনারেল খালেদ মোশাররফ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী করেন। কর্নেল (অব:) আবু তাহের সে সময় নারায়ণগঞ্জ অবস্থান করছিলেন। কর্নেল তাহের ছিলেন জিয়াউর রহমানের একজন বিশেষ শুভাকাক্সক্ষী। তিনি বন্দুকের শক্তিতে সমাজতন্ত্র কায়েমের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। সৈনিক-অফিসার বৈষম্য তার পছন্দ ছিল না। তার এই নীতির জন্য তাহের সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিলেন। কর্নেল তাহের বিশ্বাস করতেন জিয়াও তারই আদর্শের লোক।’
খালেদ মোশারফের নির্দেশে জিয়াকে তার বাসায় বন্দী করে রাখেন তরুণ ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ। জিয়ার বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ একটি ভুল করেন। তিনি ভুলে যান বেডরুমেও একটি টেলিফোন আছে। জিয়া কৌশলে বেডরুম থেকে ফোন করেন তাহেরকে। খুব সংক্ষেপে বলেন, ‘সেভ মাই লাইফ’।
তাহের জিয়ার আহ্বানে সাড়া দেন। তিনি ঢাকায় তার অনুগত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহিদের পাল্টা প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া থেকে ঢাকা রওনা হন, এ সময় তার সফর সঙ্গী ছিলেন শত শত জাসদ কর্মী। কর্নেল তাহেরের এই পাল্টা অভ্যুত্থান সফল হয় ৭ নভেম্বর। কর্নেল তাহের, জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। ওই দিনই পাল্টা অভ্যুত্থানে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জেনারেল খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে।
কথা ছিল, জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে আনা হবে। তারপর জাসদের অফিসে তাকে এনে তাহেরদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হবে। পরে সিপাহি-জনতার এক সমাবেশ হবে। সেখানে বক্তব্য রাখবেন জিয়া আর তাহের। কিন্তু মুক্ত হওয়ার পরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে সম্মত হননি। ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসাররা তাকে পরামর্শ দিতে থাকেন। তাহের জিয়াকে ভাষণ দিতে বলেন। জিয়া ভাষণ দিতে অপারগতা জানান।
তাহের বুঝতে পারেন জিয়া তাদের সাথে আর থাকছেন না। তিনি পুনরায় সংগঠিত হতে থাকেন। কিন্তু জিয়া বুঝতে পারেন ক্ষমতায় টিকতে হলে তাহেরসহ জাসদকে সরাতে হবে। সেই অনুযায়ী গ্রেফতার হতে থাকেন জাসদের সব নেতা। তাহেরও গ্রেফতার হন। জাসদের মতো একটি রাজনৈতিক দল যাতে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বা সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে না পারে এ জন্য জিয়া কঠোর হন।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু গত ৫০ বছরের মধ্যেই সেই ইতিহাসকে এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে সত্যিকার ইতিহাসকেই মানুষ এখন ভুলে যেতে বসেছে। ঐতিহাসিক সত্য হলো এই যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে যে অস্বাভাবিকতা ও অস্থিরতা তৈরি হয় সেই সুযোগেই
খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর সামরিক ক্যু ঘটালে পরিস্থিতি আরো জটিল রূপ লাভ করে। যার ফলে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব এক প্রকারের অবধারিত হয়ে ওঠে।
মহান স্বাধীনতার ঘোষক, জেড ফোর্সের অধিনায়ক এবং রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ফলে ৩ নভেম্বর তাকে পদচ্যুত করার ঘোষণা দিয়ে গৃহবন্দী করা হলে তার প্রতি বিরাজমান সহানুভূতি তীব্র ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়। এমন মোক্ষম সময়েই জেনারেল জিয়ার প্রতি সেনা সদস্যদের মধ্যে বিরাজমান ভালোবাসা থেকে উদ্ভূত তীব্র ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এবং তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে লে. কর্নেল (অব:) তাহের আরেকটি পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা তৈরি করেন।
খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর সামরিক ক্যু ঘটালে পরিস্থিতি আরো জটিল রূপ লাভ করে। যার ফলে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব এক প্রকারের অবধারিত হয়ে ওঠে।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা সামরিক বাহিনীর মধ্যে লিফলেট ছড়িয়ে সাধারণ সিপাহিদের উত্তেজিত করে তোলে। এই ধরনের প্রচারণার মধ্যে সবচেয়ে অপরিণামদর্শী যে ক্ষতিকর দিকটি ছিল তা হলো, সামরিক বাহিনীকে কর্মকর্তাশূন্য করার মতো দিকভ্রষ্ট প্রচারণা। সে সময়ে জাসদের চালানো প্রচারণার উল্লেখযোগ্য স্লোগানগুলো ছিল, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপরে অফিসার নাই’।
জেনারেল জিয়ার প্রতি অনুগত দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সেনা-কর্মকর্তা ও জওয়ানরা লে. কর্নেল (অব:) তাহেরের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আগে থেকে আঁচ করতে পেরে পৃথকভাবে একটি আগাম পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ফেলেন। সেই অনুযায়ী ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ৭ নভেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে অর্থাৎ জাসদের অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার ১ ঘণ্টা আগেই দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির জওয়ানরা মেজর মহিউদ্দিন এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হকের নেতৃত্বে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তাকে মুক্ত করেন এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে তাকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসেন।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা যখন জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে কর্নেল তাহেরের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেনানিবাসে আসে তখন তারা খুবই হতাশ হয়। লে. কর্নেল (অব:) তাহের নিজেও হতাশ হয়ে পড়েন। তার পরও শেষ কৌশল হিসেবে তিনি জেনারেল জিয়াকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির হেড কোয়ার্টার থেকে বের করে আনার জন্য নিজেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে পাল্টে গেছে। সাধারণ সিপাহিদের সাথে জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবে।
প্রকৃতপক্ষে ৭ নভেম্বর ছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনাবলির চেইন রিঅ্যাকশন। ১৫ আগস্টের নায়করা শেখ মুজিবকে হত্যার পর ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়ায় জনসাধারণের মনে এই বিশ্বাস প্রবল হয় যে এই অভ্যুত্থান ঠেকাতে ৩ নভেম্বরের সামরিক ক্যুদেতারা ছিলেন নিশ্চিতভাবেই ‘ভারতপন্থী’।
জনতার একটা বড় অংশের মধ্যে ক্রিয়াশীল এ ভাবনা পরিপক্বতা লাভ করল তখন, যখন তারা দেখলেন রাজপথে খালেদ মোশাররফের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ ও তার মা শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল বের করেছেন।
৭ নভেম্বরের সর্বাত্মক সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লব এনে দেয় রক্তিম সূর্যোদয়। স্বাধীনতার পর মুক্তির কক্ষপথে আপন আলোয় পথ খুঁজে পায় নতুন বাংলাদেশ। তাই প্রতি বছর ৭ নভেম্বর আসে আমাদের আত্মজাগৃতির নাকাড়া বাজিয়ে।



