বঙ্গবীরকে ফিল্ড মার্শাল উপাধি দেয়া হোক

মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী
মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী |সংগৃহীত

সৈয়দ মোহাম্মদ তকিউল্লাহ
বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ছিলেন যুদ্ধজয়ী সফল সেনানায়ক। তিনি তিনটি দেশের সেনাবাহিনীতে প্রতিনিধিত্ব এবং তিনটি দেশের যুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দেন, যা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে অনন্য নজির।

ওসমানীর জন্ম ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বরসহ কৃতিত্বপূর্ণ ফল করায় ব্রিটিশ সরকার তাকে পুরস্কৃত করে। ১৯৩৯ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিভাগে এমএ প্রথমপর্ব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স ট্রেনিং কোরের সার্জেন্ট থাকাকালীন ১৯৩৯ সালে ওসমানী ব্রিটিশ ভারতীয় টেরিটোরিয়াল ফোর্সেসের জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে মনোনীত হন এবং চতুর্থ আরবান ইনফ্যান্ট্রিতে যোগ দেন। ১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর সামরিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ওসমানী কমিশন লাভ করেন এবং ১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা রণাঙ্গনে এক বিশাল বাহিনীর অধিনায়করূপে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে যুদ্ধোত্তর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ায় পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু ওসমানীকে সৈনিকের চাকরি ছেড়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরিতে যোগদানের আহ্বান জানান। ওসমানী সবিনয়ে তাতে অসম্মতি জানান।

পাকিস্তানের পক্ষে সেনাবাহিনীর বিভক্তিকরণ সম্পন্ন করে ১৯৪৭ সালে ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে আগমন করেন এবং সেদিনই তাকে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ১৯৫১ সালে পাঞ্জাব যুদ্ধে ওসমানীর অসম সাহসিকতা এবং সফলতা পাক প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভূয়সী প্রশংসিত হয় এবং তারই ফলস্বরূপ ১৯৫১ সালে ৮ নভেম্বর ওসমানীকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক এবং ১২ ডিসেম্বর ১৯৫৫ পাকিস্তান সেনাসদর অপারেশন পরিদফতরে জেনারেল স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

১৯৬৭ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ঘটনাচক্রে অবসর গ্রহণের ঠিক চার বছর চার মাস ২৭ দিনের মাথায় বঙ্গবীর ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে আসীন হন।

৪ এপ্রিল ১৯৭১ সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়ার চা বাগানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধরত বিভিন্ন ইউনিট কমান্ডাররা মিলিত হন। রাজনৈতিক শূন্যতার সঙ্কট মোকাবেলা এবং যুদ্ধ প্রক্রিয়াকে বৈধতার আচ্ছাদন দেয়ার প্রয়োজনে এমএজি ওসমানীকে কমান্ডার-ইন-চিফ (সর্বাধিনায়ক) এবং এম এ রবকে ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ (উপ-সর্বাধিনায়ক) নির্বাচিত করা হয়। ১১ এপ্রিল আগরতলায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে ওসমানীকে মন্ত্রীর মর্যাদায় বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি (সিএনসি) হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন করা হয় এবং মুক্তিবাহিনী গঠনের জন্য এককভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়।

ওসমানীর রণনীতি ও রণকৌশলের সাফল্য সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত শত্রুর এ অবস্থা দাঁড়ায় যে একজন বক্সার রিংয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে ক্লান্ত হয়ে ঘুরছে এবং একটা কড়া ঘুষি খেলে পড়ে যাবে।

যৌথবাহিনী গঠনকালে ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধানকে তার অন্তর্ভুক্ত করতে কোনোক্রমেই রাজি হয়নি। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় বাহিনী জেনারেল ওসমানীকে জেনারেল অরোরার সাথে সংযুক্ত করতে বাধ্য হয়। অবশ্য এ ছিল শুধু ইন্দিরা গান্ধীর সম্মান রক্ষার্থে। কার্যত ভারত জেনারেল ওসমানীকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে যৌথবাহিনীর অপারেশন শুরু করে এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাতেই সম্মতি দেন। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে অভিমান করে তিনি ১১ ডিসেম্বর কলকাতা ত্যাগ করে পূর্বাঞ্চলের রণাঙ্গনে চলে যান।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময়ও ওসমানীকে অসম্মানজনকভাবে এড়ানো হয়েছে। আত্মসমর্পণ দলিলে যৌথ বাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসাবে জেনারেল ওসমানীর সম্পৃক্ততা বাতিল করা হয়। মানেক শ যৌথ কমান্ডকে পাশ কাটিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তার সুপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। নিঃসন্দেহে এসব শঠতামূলক কাজ বাংলাদেশের জন্য লজ্জার- মুক্তিযুদ্ধের জন্য কলঙ্কের। কারণ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সব শ্রম, সব ত্যাগের প্রশান্তি ছিল যে আত্মসমর্পণ পর্ব সেখানে তাদের অনুপস্থিতি ছিল অকল্পনীয়। মুক্তিযোদ্ধা তথা বাংলাদেশীদের মনে এ ক্ষত চির জাগরুক হয়ে থাকবে।

১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের তিন-চার ঘণ্টা আগে ভারতীয় সেনা সদর যখন বাংলাদেশ সরকারকে আত্মসমর্পণের সময় অবহিত করে তখন জেনারেল ওসমানী কুমিল্লার ময়নামতি রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর লে. জেনারেল স্বোগত সিংয়ের সাথে মধ্যাহ্নভোজে ছিলেন। সেই সময় জেনারেল স্বোগত সিং ওসমানীকে আত্মসমর্পণ বিষয়ে কিছুই জানাননি। ভোজের পর তার যাওয়ার কথা ছিল ঢাকার নিকটবর্তী ডেমরায় লে. কর্নেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন এস ফোর্সের রণাঙ্গন পরিদর্শনে। তিনি যখন রওনা হতে উদ্যত তখন স্বোগত সিং এস ফোর্স চলন্ত অবস্থায় আছে বলে চরম হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে জেনারেল ওসমানীকে সেখানে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী তার এ অবস্থান জানতেন। জেনারেল ওসমানী পরোক্ষ সংবাদে জানতেন কখন আত্মসমর্পণ হচ্ছে। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তার কাছ থেকে ঢাকায় প্রবেশের কোনো নির্দেশ না পাওয়ায় সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী এবং চিফ অব স্টাফ এমএ রব, ডা: জাফরুল্লাহ, শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামালসহ অন্যরা আগরতলা থেকে উড্ডয়ন করে সিলেটের আকাশে মৃত্যু পরোয়ানা হাতে বিভীষিকাময় সময় মোকাবেলা করছিলেন। অথচ এর অল্পক্ষণ পরেই লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতা থেকে ঢাকার ওপর দিয়ে আগরতলায় গিয়ে ওসমানীর অবস্থান জেনে সেখান থেকে লে. জেনারেল স্বগোত সিংসহ অন্যদের নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। যে কারণে আত্মসমর্পণ দলিলে উল্লিখিত সময় থেকে ২৪ মিনিট (৪-৩১ থেকে ৪-৫৫ মি.) বিলম্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর উপস্থিতি ছাড়াই এবং আত্মসমর্পণ দলিলে আমাদের কোনো পক্ষ না করে, আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত করে এটিকে ভারতের ব্যর্থ সামরিক ইতিহাসের একমাত্র জয়ের তিলক যোগ করে।

কেউ যদি মনে করেন, ৯ মাসের যুদ্ধের ফল এই স্বাধীনতা বা ১৩ দিনের যুদ্ধে কেউ স্বাধীনতা এনে দিয়েছে সেটি আহম্মকের চিন্তা ছাড়া কিছু নয়। স্বাধীনতা এসেছে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের সফল পরিণতি ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। ভারত বাংলার মানুষের প্রতি দরদি হয়ে তাদের জান-মাল, শক্তি সামর্থ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার অমিয় সুধা মুখে তুলে দিয়েছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ভারত ঠিক তখনই এগিয়ে এসেছে যখন আমাদের এবং তাদের জন্য পরিবেশগত উপযোগিতা এসেছে। দুনিয়াতে কেউ নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় না। সবাই চায় নিজের স্বার্থ হাসিল করতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা এর ব্যতিক্রম ভাবা ভুল।

বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী আজো মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি নায়ক। ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি উদাসীন, চিরকুমার মানুষটির দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও যথোপযুক্ত সেনাবিন্যাসে অতুলনীয় দক্ষতা যুদ্ধকে কাক্সিক্ষত সময়ের আগেই বিজয়ের আঙিনায় নিয়ে গেছে। একটি রেওয়াজ আছে যে, সাধারণত যুদ্ধজয়ী জেনারেলদের ফিল্ড মার্শাল পদবি দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে জেনারেল ওসমানীকে ফিল্ড মার্শাল পদবিতে ভূষিত করার কার্যক্রম শুরুও হয়েছিল। কিন্তু তা হঠাৎ বন্ধ করে তার ফাইল ‘আপাতত স্থগিত’ লিখে ফেলে রাখা হয়। ধারণা করা হয়, পার্শ্ববর্তী দেশের চাপে ওসমানীকে ফিল্ড মার্শাল পদবি দেয়া থেকে বিরত ছিল তৎকালীন সরকার।

আজ সময় এসেছে যুদ্ধজয়ী সে জেনারেলকে মরণোত্তর ফিল্ড মার্শাল ঘোষণা করার। এই মহান বীরকে সম্মানিত করা মানে কার্যত দেশকে সম্মানিত করা। এই সফল সর্বাধিনায়ককে মরণোত্তর ফিল্ড মার্শাল উপাধি দিতে আমাদের তো কোনো বাধা থাকার কথা নয়? ১৯৮৫ সালে এই মহান সেনানায়ককে রাষ্ট্র মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছে। সব হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে যথাযোগ্য ব্যক্তিকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করার এখনই সময়। অন্যথায় এই দেশে ভবিষ্যতে আর কোনো বীরের জন্ম হবে না।

আগামী বিজয় দিবসের আগেই জেনারেল ওসমানীকে মরণোত্তর ফিল্ড মার্শাল পদবিতে ভূষিত করার জোর দাবি তোলার জন্য সর্বস্তরের মানুষের প্রতি অনুরোধ করছি এবং আমার সম্মানিত শিক্ষক প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছেও যুদ্ধজয়ী এই জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে মরণোত্তর ফিল্ড মার্শাল উপাধি প্রদানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]