আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামী ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন। সেই ঘটনা সামনে রেখে প্রতি বছর নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ দিন সারা বিশ্বে নারীরা সমঅধিকার, স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক অধিকার ইত্যাদি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। নারীর ক্ষমতায়নে সব বাধা দূর করার স্লোগানে দিবসটি পালিত হয়। আবার কোনো কোনো পক্ষ নারী ও পুরুষকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে, যা সুস্থ সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়ক নয়। অনেকের ধারণা, নারী ও পুরুষকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা দীর্ঘ দিনের একটি পশ্চিমা ষড়যন্ত্র বা অ্যাজেন্ডা।
পাশ্চাত্য নয়; বরং ইসলামই নারীকে পুরুষের চেয়ে অধিক অধিকার ও মর্যাদায় ভূষিত করেছে। সমাজে ন্যায্য অধিকার, প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদাজনক আসন দিয়েছে; কখনো মা, কখনো স্ত্রী, কখনো মেয়ে, আবার কখনো বোন হিসেবে। ইসলাম নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার ব্যবস্থা করেছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনে যে ১২ জনকে ওয়ারিশ হিসেবে গণ্য করা হয় তাদের মধ্যে আটজনই নারী। একইভাবে নারীর জন্য ‘সম্মানজনক দেনমোহর নির্ধারণ’ বিয়ের অন্যতম শর্ত হিসেবে পুরুষের ওপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে ইসলামই প্রথম নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছে। রাসূল সা: একমাত্র ব্যক্তি যিনি সব ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। নারীর প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে সদাসতর্ক রাসূল সা: মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত ঘোষণার সাথে সাথে নারী জাতিকে পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে আমার সদ্ব্যবহারের সর্বাপেক্ষা অধিকারী ব্যক্তি কে? জনৈক ব্যক্তির এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে রাসূল সা: পরপর তিনবার বলেন, ‘তোমার মা’। তিনবার মায়ের অবস্থান সর্বোচ্চে রাখার পর রাসূল পিতাকে দ্বিতীয় স্থান দেন। এ জন্যই জর্জ বানার্ড শ’ বলেছিলেন, একমাত্র হজরত মুহাম্মদই সা: নারীদের যথাযথ সম্মান দিয়েছেন।
শুধু মুখে বা আইন করে সমাজের বুকে নারীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই রাসূল সা: ব্যক্তি জীবনে আগে তা নিজে করে দেখিয়েছেন। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি)
ইসলাম নারীকে যে উচ্চাসনে বসিয়েছে তা দুনিয়ার আর কোনো ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থায় নেই। অন্যান্য ধর্মে বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে মেয়ের কোনো অধিকারই স্বীকৃত নয়। সম্প্রতি বাবার সম্পত্তির (স্থাবর-অস্থাবর) উত্তরাধিকার থেকে হিন্দু নারী বা কন্যাকে বঞ্চিত করার বিধান কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। অধিকাংশ মুসলিম দেশ, সমাজ ও পরিবারে নারীর ব্যাপারে ইসলাম প্রদত্ত নারী অধিকার নীতির যথাযথ প্রতিফলন দেখা যায় না বললেই চলে। অধিকাংশ পরিবারে মা, স্ত্রী, বোন ও কন্যার প্রতি মর্যাদাজনক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে। পরিবার পরিচালনায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের যেমন আর্থিক মূল্যায়ন হয় না, তেমনি তাদের নির্ভরশীল করে রাখা হয়। নারীর প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার না দেয়াই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ মূল সমস্যার দিকে না গিয়ে আমাদের সমাজের কিছু নারীবাদী বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতায় নামেন। সম্প্রতি প্রকাশ্যে নারীর ধূমপানের স্বাধীনতা, খোলামেলা পোশাক পরার স্বাধীনতার দাবিতে মিছিল মিটিং করে নারী স্বাধীনতার বিষয়টিকেই হালকা ও হাস্যরসের বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে।
যারা অতিমাত্রায় নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাদের পরিবারে স্বামীর কর্তৃত্ব মেনে নিতে কষ্ট হলেও অফিস-আদালতে অনায়াসে বসের কর্তৃত্ব ও আনুগত্য মেনে নেন। অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়-অযৌক্তিক আদেশ নির্দেশও মেনে নিতে হয়। সেখানে তারা বিব্রত হন না। অফিসে পুরুষকে বস মানতে যদি নারীর ব্যক্তিত্বে আঘাত না লাগে, তাহলে পরিবারে যিনি কর্তা তার আনুগত্যে এত অনীহা কেন?
মুসলমান হিসেবে আমাদের অসচেতনতার কারণেই তথাকথিত নারীবাদীরা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণার সুযোগ নেয়। আমরা যদি পারিবারিক ও সমাজ জীবনে নারীকে তার ইসলাম প্রদত্ত অধিকারগুলো দিতাম তাহলে অধিকাংশ নারী সম্পদশালী হতেন। মুসলিম নারীরা অন্যদের রোলমডেল হতে পারতেন।
সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক নারীও সচেতন নন। অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্ক ও সামাজিকতার কথা ভেবে নারীরা প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলেও আইনের আশ্রয় নেন না। অথচ এসব অধিকার আদায়ে নারী সংগঠনগুলোর যেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না, আমাদের মুসলিম কমিউনিটির মধ্যেও গঠনমূলক ও কার্যকর কোনো তৎপরতা নেই। সামাজিক নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের সক্রিয় হওয়া দরকার।
অনেক সময় নারীর প্রতি অসম্মানের কারণ খোদ নারীরাই। নারীরা যদি কথাবার্তা, চাল-চলন, আচার-আচরণ, পোশাক আশাকে শালীনতা বজায় রেখে যে যার অবস্থানে দক্ষতা-যোগ্যতা ও প্রতিভার স্ফূরণ ঘটাতে পারেন তাহলে সবাই তাদের সম্মান করতে বাধ্য হবে। সে ক্ষেত্রে নারীদেরকেই আত্মগঠনে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে আমরা নারীরাই যেন নির্যাতনের কারণ হয়ে না উঠি সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। পরিবারে শাশুড়ির হাতে পুত্রবধূ, পুত্রবধূর হাতে শাশুড়ি, ননদের হাতে ভাবী, ভাবীর দ্বারা ননদ বঞ্চিত-নির্যাতিত হচ্ছে। নারীদের হাতেই বাড়ির গৃহকর্মী অথবা অফিসের কোনো নারী কর্মী নিপীড়িত হচ্ছে যা গোটা নারী সমাজকে বিব্রত করে।
নারী পুরুষের সম্মিলিত ও দায়িত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ভারসাম্যমূলক সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত। নারীর ন্যায্য অধিকার প্রদানে প্রতিটি পুরুষকে আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতার সাথে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে তাদের পরিবারে মা, স্ত্রী, কন্যা, বোন এদের সবার শরিয়ত নির্ধারিত হক আদায় করে সবার কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ নারী সমাজকে বঞ্চিত ও অনুন্নত রেখে সমাজ এ রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। শুধু কর্মক্ষেত্র ও বহিরাঙ্গনে নয়, আমাদের প্রতিটি ঘরে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারীর প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে।
ইসলামে নারী ও পুরুষের মধ্যে যে ভারসাম্যমূলক অধিকার ও মর্যাদার নীতি ঘোষিত হয়েছে, তার যথার্থ প্রয়োগেই কেবল নারীর প্রকৃত মুক্তি অর্জন সম্ভব।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, মানবাধিকার ও আইনি সুরক্ষাকেন্দ্র (মাসুক)