বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে যখন ঢাকের শব্দে মুখরিত হয় নগর ও গ্রাম, তখন তার ছায়ায় ফুটে ওঠে আমাদের সমাজের বহুস্তরীয় বাস্তবতা।
সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ
দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলেও, এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সামগ্রিক বাঙালি সংস্কৃতিতে। প্রতিমা নির্মাণ, আলোকসজ্জা, নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য, সবমিলিয়ে এটি এক সাংস্কৃতিক মহাযজ্ঞ। তরুণ শিল্পীরা এ সময়ে নিজেদের সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পান, যা একধরনের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ঘটায়।
সামাজিক সংহতির প্রতিচ্ছবি
বাংলাদেশের মতো বহুত্ববাদী সমাজে দুর্গাপূজা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বার্তা বহন করে, সহাবস্থান ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার। মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা উদযাপন এবং স্থানীয় মুসলমানদের সহযোগিতা, নিরাপত্তা ও অংশগ্রহণ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রতিচ্ছবি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু এলাকায় পূজামণ্ডপে হামলা বা উসকানিমূলক গুজবের ঘটনা উদ্বেগজনক। এগুলো আমাদের সামাজিক সংহতির ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই এ উৎসবের সময় রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়- সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া এবং বিভাজনের রাজনীতিকে প্রতিহত করা।
অর্থনীতির আবর্তন
দুর্গোৎসবের প্রভাব শুধু ধর্মীয় নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক ইঞ্জিনও। দুর্গাপূজা ঘিরে আমাদের দেশে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটে। প্রতিমাশিল্পী, কাপড় ব্যবসায়ী, সাজসজ্জার দোকান, খাবার বিক্রেতা, সবাই এ সময়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। গ্রামীণ শিল্প থেকে শহুরে বিপণন, দুর্গাপূজা এক বিশাল অর্থনৈতিক চক্রের চালিকাশক্তি। সবাই এ সময়ে নতুন আশার আলো দেখেন। বিশেষ করে পোশাক ও প্রসাধনী খাতে বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রশ্ন থাকেÑ এ অর্থনৈতিক প্রবাহ কতটা টেকসই? এর সুবিধা কি শুধু শহরকেন্দ্রিক? গ্রামীণ শিল্পীদের জন্য কি পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হচ্ছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে যদি আমরা উৎসবকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ইঞ্জিন হিসেবে দেখতে চাই।
২
শারদীয় দুর্গোৎসব : উৎসবের রঙে রাঙা বাংলার হৃদয়
বাংলার আকাশে যখন শরতের নীল মেঘ ভেসে বেড়ায়, কাশফুলের শুভ্রতা ছুঁয়ে যায় মন, তখন জানি, দুর্গা আসছেন। দেবী দুর্গার আগমন শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি বাঙালির আত্মার উৎসব, সংস্কৃতির উচ্ছ্বাস এবং সামাজিক সংহতির এক অনন্য প্রতীক।
দুর্গোৎসবের পাঁচটি দিন যেন বাংলার হৃদয়ে এক মহাকাব্য রচনা করে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে থাকে আবেগ, আনন্দ, আর মিলনের ছোঁয়া। প্রতিমা গড়ার শিল্প, আলোকসজ্জার নান্দনিকতা, আর ঢাকের বাদ্য যেন একসাথে বলে ওঠে- ‘এসো মা, এসো’!
ধর্মীয় ভাবনা ও সামাজিক বাস্তবতা
দেবী দুর্গা শুধু অসুরনাশিনী নন, তিনি নারী শক্তির প্রতীক। তাঁর দশ হাতে অস্ত্র, কিন্তু চোখে করুণা। এ উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নারীর শক্তি ও সম্ভ্রম রক্ষার বার্তা। আজকের সমাজে যখন নারী নির্যাতন, বৈষম্য ও অবহেলা চোখে পড়ে, তখন দুর্গাপূজা যেন এক নীরব প্রতিবাদও বটে। তাই বলা যায়, শারদীয় দুর্গাপূজা আমাদের শুধু আনন্দ দেয় না, ভাবনার খোরাকও জোগায়। ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে কিভাবে আমরা সমাজে সহনশীলতা, সংস্কৃতির বিকাশ এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে পারি, এ প্রশ্নগুলো সামনে আসে। এ উৎসব যেন শুধু আলোর নয়, আলোকিত চিন্তারও উৎস হয়ে ওঠে, এটা হোক আমাদের প্রত্যাশা।
প্রজন্মের চোখে পূজা
আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে দুর্গোৎসব শুধু পূজা নয়, এটি ফ্যাশন, ফটোশুট, ইনস্টাগ্রাম রিল, আর বন্ধুত্বের নতুন সংজ্ঞা। কিন্তু এর মধ্যেও তারা খুঁজে পায় ঐতিহ্যের ছোঁয়া, পরিবারের সাথে কাটানো মুহূর্ত, আর একাত্মতার আনন্দ।
বিসর্জনের বিষাদ
দশমীর দিন যখন প্রতিমা বিসর্জন হয়, তখন এক অদ্ভুত বিষণ্নতা ছেয়ে যায়। যেন মা চলে যাচ্ছেন, কিন্তু রেখে যাচ্ছেন আশীর্বাদ, শক্তি আর আগামী বছরের অপেক্ষা। শারদীয় দুর্গোৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আনন্দের মাঝে আছে প্রতিবাদ, ঐতিহ্যের মাঝে আছে নবজাগরণ, আর ধর্মের মাঝে আছে মানবতা। এ এবারের পূজায়ও আসুন, আমরা শুধু দেবীকে নয়, নিজেদের ভেতরের শুভ শক্তিকে জাগিয়ে তুলি।
শুভ শারদীয়া!
লেখক : ট্রাস্টি, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার