শত্রুর মোকাবেলায় সশস্ত্রবাহিনী কি প্রস্তুত

আজকে যদি আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর বা নাগাল্যান্ডের কোনো স্থানে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা জঙ্গি হামলার নাটক সাজায় এবং তারা বলে যে, বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি এসে মনিপুরে আক্রমণ করেছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা যদি বাংলাদেশের কোনো কেপিআই বা প্রতিরক্ষা স্থাপনায় সরাসরি বিমান হামলা চালায় অথবা মিসাইল দ্বারা আক্রমণ করে সেটি প্রতিরোধ করার মতো কোনো ক্ষমতা বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর নেই। সুতরাং সময় এসেছে, আমাদের নড়ে চড়ে বসার এবং শুধু সেনানিবাস তৈরি করে বা সেনাবাহিনীর আকার বাড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা খুব কঠিন। আমাদের প্রয়োজন যুদ্ধসক্ষমতা এবং শত্রুকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার মতো যুদ্ধাস্ত্র

একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার মূল দায়িত্ব সে দেশের সামরিক বাহিনীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা এবং আকাশপথে শত্রুর প্রতি আক্রমণ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

১৯৯১ সালে আমেরিকা ইরাকে এক মাস ধরে শুধু এয়ার পাওয়ার ব্যবহার করে। একইসাথে বোমা বর্ষণ করে ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। পরবর্তীতে স্থল অভিযানের সময় মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সেই সময়ের সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ইরাককে পরাভূত করে। এরপর থেকে আসলে বিশ্বজুড়ে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ইম্প্রুভ করা, একই সাথে ফাইটার এয়ার ক্রাফটের মাধ্যমে নিজের আকাশ মুক্ত রাখা এবং শত্রুকে ডমিনেট করার ব্যাপারে গোটা দুনিয়াজুড়ে পরাশক্তিগুলো প্রতিযোগিতা শুরু করে।

এর আগে ১৯৬৭ এবং ’৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে এয়ার পাওয়ার সিঙ্গেল ব্যাটেল উইনিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে যা তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইলকে বিজয় এনে দিয়েছিল। আমরা যদি ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে তাকাই তবে দেখব, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে গত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে নিজেদের এয়ার পাওয়ার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।

১৯৭১ সালে মাত্র ১১ দিনের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, যুদ্ধ শুরুর প্রথম দুই দিনের মধ্যে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স বাংলার আকাশে কমপ্লিট এয়ার সুপ্রিমেসি অর্জন করে। আমরা অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় আগে স্বাধীনতা লাভ করেছি। কিন্তু বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার কার্যকরী আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম চালু করতে পারেনি। আমাদের পোটেনশিয়াল বা সম্ভাব্য শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলার মতো কোনো আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম নেই। অতি সম্প্রতি সংঘটিত ইরান-ইসরাইল ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আমরা দেখতে পাই- যুদ্ধগুলো খুব স্বল্পস্থায়ী ছিল এবং আকাশপথে সীমাবদ্ধ ছিল। একদিকে যেমন ভারতের যুদ্ধবিমানগুলো পাকিস্তান তার আকাশে ঢুকতে দেয়নি, তার আগে ভূপাতিত করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান তার এয়ার ফোর্সের সক্ষমতার মাধ্যমে অতি সহজে ভারতকে সারপ্রাইজ দিতে ও যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করেছে।

এখানে স্মরণযোগ্য যে, ভারত জঙ্গি নাটক সাজিয়ে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ শুরু করলেও পরবর্তীতে লেজ গুটিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়। দিল্লি কোনোরকমে নিজের মান বাঁচাতে আমেরিকার কাছে কাকুতি মিনতি করে ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, ইরান ও ইসরাইলের ১২ দিনের যুদ্ধে, যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইল তার কয়েক শ’ বিমান দিয়ে তেহরানের আকাশ সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং ইচ্ছেমতো গোলাবর্ষণ করতে থাকে। বিপরীতে ইরান মিসাইল সক্ষমতা দেখিয়েছে এবং তেহরানের অত্যাধুনিক মিসাইলের সামনে একটা পর্যায়ে ইসরাইলের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম অকার্যকর মনে হয়েছে। একদিকে যেমন যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম ইসরাইলের বিমানবাহিনীর আক্রমণের সামনে একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে ইরানের অত্যাধুনিক মিসাইল সিস্টেম ইসরাইলের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ভেদ করে ইসরাইলকে বিপর্যস্ত করে তোলে।

কাজেই এ দু’টি যুদ্ধ থেকে আমরা বলতে পারি, একদিকে যেমন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং আধুনিক এয়ারক্র্যাফটের গুরুত্ব রয়েছে, একই সাথে দূরবর্তী লক্ষ্য বস্তুতে আক্রমণ করতে মিসাইল সিস্টেমও অত্যন্ত কার্যকর। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দু’টির কোনোটি আমাদের কাছে নেই। বাংলাদেশের না আছে কোনো আধুনিক ফাইটার এয়ারক্র্যাফট, না আছে কোনো আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অথবা মিসাইল সিস্টেম।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একটি বড় ভূমিকা ছিল। ইরানের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারদের হত্যাকাণ্ডের সহায়তা করা এবং ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অকার্যকর করে রাখার ক্ষেত্রে বহু ভারতীয় এজেন্ট কাজ করেছে। অন্যদিকে, অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের ভেতরেও ‘র’-এর বেশ কিছু এজেন্ট নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ‘র’ যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে তা অনেকের জানা। বাংলাদেশের প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ‘র’-এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে পুরো রাষ্ট্রটি পরিচালিত হতো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রেসক্রিপশনে। বর্তমানে সেই অবস্থার উন্নতি হলেও প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ‘র’-এর এজেন্টরা এখনো যথেষ্ট সক্রিয়। বাংলাদেশের যেকোনো নিরাপত্তা পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে এ বিষয় উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং উন্নতমানের ফাইটার এয়ারক্র্যাফট যা আকাশে ডগফাইট করতে সক্ষম- এ ধরনের এয়ারক্র্যাফট কেনার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা ভারতীয় আধিপত্য।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফরের সময় চীনের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ক্রয়ের ব্যাপারে উভয় দেশ সম্মত হয়, কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফেরার পরে বিষয়টি নিয়ে আর তেমন কিছু শোনা যায়নি। ধারণা করা হয়, এর পেছনে ইন্ডিয়ান চাপ ও প্রশাসনের ভেতরে ঢুকে থাকা ‘র’-এর এজেন্টের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

আমরা বিগত সাড়ে ১৫ বছরে অনেক উন্নয়নের কথা শুনি। প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, তার আমলে গত ১৫ বছরে সেনাবাহিনীতে তিনটি ডিভিশন ও অনেকগুলো সেনানিবাস স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু সত্য, এখানে ফাঁকি রয়েছে। তিনটি ডিভিশনে প্রায় ৩০ হাজার সেনা থাকেন। সেনানিবাসগুলো প্রস্তুত করতে বহু কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সেখানে অত্যাধুনিক বাসস্থান ও অফিস নির্মাণ করা হয়েছে যার খরচের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। যদি এর কিছু অংশ বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যয় করা হতো তাহলে আজকে আমরা একটি উন্নত আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দেখতে পেতাম এবং উন্নতমানের আধুনিক ফাইটার এয়ারক্র্যাফট আমাদের এয়ারফোর্সের কাছে থাকত, যা দিয়ে আমরা যেকোনো সময় শত্রুকে মোকাবেলা করতে পারতাম। কিন্তু সত্য যে, সে ধরনের কোনো প্রচেষ্টা সরকারের দিক থেকে ছিল না। যার পরিণতি আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজকে যদি বাংলাদেশ আক্রান্ত হয় সেটি অবশ্যই আকাশপথে হবে মিসাইলের মাধ্যমে অথবা সরাসরি এয়ার বোম্বিংয়ের মাধ্যমে। কিন্তু সেটি প্রতিরোধ করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই! এর দায়ভার কার?

আজকে যদি আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর বা নাগাল্যান্ডের কোনো স্থানে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা জঙ্গি হামলার নাটক সাজায় এবং তারা বলে যে, বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি এসে মনিপুরে আক্রমণ করেছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা যদি বাংলাদেশের কোনো কেপিআই বা প্রতিরক্ষা স্থাপনায় সরাসরি বিমান হামলা চালায় অথবা মিসাইল দ্বারা আক্রমণ করে সেটি প্রতিরোধ করার মতো কোনো ক্ষমতা বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর নেই। সুতরাং সময় এসেছে, আমাদের নড়ে চড়ে বসার এবং শুধু সেনানিবাস তৈরি করে বা সেনাবাহিনীর আকার বাড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা খুব কঠিন। আমাদের প্রয়োজন যুদ্ধসক্ষমতা এবং শত্রুকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার মতো যুদ্ধাস্ত্র। মডার্ন যুগে যেহেতু যুদ্ধ শুরু হয় আকাশপথ দিয়ে, কাজেই আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ও এয়ারফোর্সের সক্ষমতার দিকে শিগগির নজর দেয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি আমাদের এই আকাশ প্রতিরক্ষার দুর্বলতা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন রাষ্ট্রীয় একটি গণমাধ্যম প্রচার করেছে। বিষয়টি ইতিবাচক। এ ধরনের একটি প্রতিবেদন গত ১৫ বছর কোনো টিভি চ্যানেল করতে পারেনি। আজকে অন্তত একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা সম্ভব হলো। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কবে সম্ভব হবে কি-না আমাদের জানা নেই। আমরা যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই, অবশ্যই আমাদের শত্রুর মোকাবেলা করার মতো সাহস ও শক্তি থাকতে হবে। সব বাধা উপেক্ষা করে সশস্ত্রবাহিনী মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে-এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর