পলাশীর ট্র্যাজেডি আমাদের যা শেখায়

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নিজেদের অনৈক্যে রবার্ট ক্লাইভের ৩,৫০০ জন ইংরেজ বাহিনীর কাছে নবাব সিরাজের ৫০,০০০ বাহিনীর পরাজয় হয়েছিল। এটা আমাদের জাতির জন্য একটা বড় শিক্ষা। আমরা যদি অনৈক্য, হানাহানি ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতি হতে পারি, তাহলে আমরা প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের হাত থেকে মুক্ত রাখতে পারব।

বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রধানতম চরিত্রের একজন। তিনি ১৭৩৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিহারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মীর্জা জয়নদ্দীন, মা আমেনা বেগম। তার দাদার নাম মীর্জা আহমেদ। নানা ছিলেন মীর্জা আলীবর্দ্দী মোহব্বতজঙ্গ বাহাদুর।

১৯৪০ সালে মীর্জা আলীবর্দ্দী মোহব্বতজঙ্গ সুবে বাঙালার মসনদে বসেন। নানা আলীবর্দ্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৭ সালে নবাবুল মূলক মনসুর-উল-সিরাজ-উদ্দৌলা শাহকুলী খান মীর্জা মুহাম্মদ হায়বৎজঙ্গ বাহাদুর খেতাব নিয়ে সিরাজ বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবরূপে মসনদে বসেন। তখন তার মাত্র বয়স বাইশ বছর।

নবাব সিরাজের অভিষেকের দিন শাহী দরবারে রাজ্যের আমির, ওমরাহ, পাত্র-মিত্র, রাজা-মহারাজা, জমিদার-তালুকদার, সিপাহসালার, সম্মানিত প্রজাবৃন্দ, ওলন্দাজ, ফরাসী, পর্তুগিজ, প্রমুখরা উপঢৌকনসহ উপস্থিত হয়ে নবাবের কাছে আনুগত্যের শপথ নেন। কেবল উদ্যত ষড়যন্ত্রকারী ইংরেজরা দরবারে অনুপস্থিত থাকে এবং শুরু হয় ইংরেজ ও হিন্দুদের ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রকারীরা শুরুতে সিরাজের পরিবারে গৃহ বিবাদের বীজ বপন করা হয়। তারা শেঠকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন দিল্লি থেকে নবাবী ফরমান সিরাজের নামে না এনে তার খালাত ভাই শওকতজঙ্গের নামে আনেন। এই শওকতজঙ্গ ছিলেন ঘষেটি বেগমের ছেলে।

জগৎ শেঠ, মাহতাব চাঁদ গংদের চক্রান্তে দিল্লি থেকে নবাবী ফরমান শওকতজঙ্গের নামে আনার পর নবাব সিরাজ জীবিত শওকতজঙ্গকে ডেকে পাঠান। এর মধ্যে খবর আসে শওকতজঙ্গ খুন হয়েছেন। শওকতজঙ্গের খুন হওয়ার কথা শুনে নবাব সিরাজ মর্মাহত হন। এ জন্য মোহন লালকে তিরস্কার করেন। বয়সে তরুণ হলেও নবাব সিরাজ উপরিউক্ত ঘটনাবলি থেকে বুঝতে পারেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।

১৭৫৬ সালে সিরাজ ক্ষমতায় আসার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্গ স্থাপন, অবৈধ শক্তি বৃদ্ধি, দফতর অপব্যবহার ও কলকাতায় জমিদারি প্রয়োগে সার্বভৌম ক্ষমতার মতো বাস্তবভিত্তিক তিনটি অভিযোগ আনেন। তা ছাড়া কোম্পানিটি রাষ্ট্রবিরোধী ও নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ষড়যন্ত্রকারীদের অনেককে কলকাতায় আশ্রয় দেয়। তাই নবাব সিরাজ ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর রজার ড্রেকের সাথে কূটনৈতিক সমাধান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রজার ড্রেক তাতে সায় না দিয়ে বরং সিরাজকে শক্তি প্রয়োগ করতে বাধা দেন। নবাব সিরাজ অবশেষে কলকাতা অবরোধ করেন। কলকাতার পতন ঘটে। উদ্ধত ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং হুগলী বন্দরে ব্যাপক লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। নবাব সিরাজ চারদিকে ষড়যন্ত্রের কারণে মারাঠা এবং আবদালীর আক্রমণের আশঙ্কায় আত্মরক্ষামূলক আলীনগর সন্ধি ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭ সম্পাদন করেন। ওই সন্ধিতে কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ, টাঁকশাল স্থাপনের অনুমোদন রয়েছে। সন্ধিতে নবাব ১৭১৭ সালের ফরমান মেনে নেন। তা ছাড়া কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ বাবদ তিন লাখ টাকা এবং রণজিৎরায়, উর্মিচাঁদ প্রমুখ মধ্যস্থাতাকারীর চল্লিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা সম্মানী দিতে রাজি হন।

আলীনগর সন্ধির পর ক্লাইভ নবাবের বাধানিষেধ সত্ত্বেও ফরাসিদের উৎখাত করে চন্দ্রনগরের দুর্গের পতন ঘটায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতার কাউন্সিল ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ে ক্লাইভ নবাব সিরাজকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত নেন। যারা সিরাজকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল ক্লাইভ তাদের সবাইকে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

এই ষড়যন্ত্রকারী প্রত্যেকে পৃথকভাবে নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন। অথচ সব স্বার্থের ওপরে ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক শক্তি আদায়ের স্বার্থ ও বাংলার স্বাধীনতা নস্যাতের ষড়যন্ত্র। পলাশীর ষড়যন্ত্রে কোম্পানিটি সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে মীর জাফরকে পেয়েছিল। এমনিভাবে প্রায় সব আমত্যদের ক্লাইভ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিল।

কোম্পানি ৩ জুন ১৭৫৭ সালে মীর জাফরের সাথে একটি গোপন চুক্তি করে। পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফরের ভূমিকা কী হবে তা ক্লাইভের সাথে চুক্তি হওয়ার পর ক্লাইভ কালবিলম্ব না করে সিরাজকে জানিয়ে দেয় যে যুদ্ধ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। অতঃপর পলাশীর প্রান্তে যুদ্ধের আয়োজন হয়। গোপন চুক্তি মোতাবেক ইংরেজ বাহিনীর অবস্থানের অনেক দূরে সেনা সমাবেশ করলেন মীর জাফর, ইয়ার লতিফ ও রায়দুর্লভ। মূল বাহিনীর অনুপস্থিতিতে ২৩ জুন যুদ্ধ শুরু হয়। চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হলেন সিরাজ-উদ্দৌলা।

ইংরেজরা মুসলমানদের কাছ থেকে বাংলার মসনদ কেড়ে নিতে হিন্দু আমত্যবর্গ ও প্রভাবশালী হিন্দু ব্যক্তিদের সহযোগিতা গ্রহণ করেছিল। হিন্দু সম্প্রদায় তাদের সহযোগিতা করে। হিন্দুদের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের উৎখাত ও নির্মূল।

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নিজেদের অনৈক্যে রবার্ট ক্লাইভের ৩,৫০০ জন ইংরেজ বাহিনীর কাছে নবাব সিরাজের ৫০,০০০ বাহিনীর পরাজয় হয়েছিল। এটা আমাদের জাতির জন্য একটা বড় শিক্ষা। আমরা যদি অনৈক্য, হানাহানি ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতি হতে পারি, তাহলে আমরা প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের হাত থেকে মুক্ত রাখতে পারব।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য