মাশরুম কোনো উদ্ভিদ নয়, এটি এক প্রকার ছত্রাক, যা আমরা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকি। অনেকে মাশরুমকে ব্যাঙের ছাতার সাথে তুলনা করে থাকে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে উভয়ই ছত্রাক, কিন্তু খাওয়ার যোগ্যতার দিক থেকে এই দুয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। ভক্ষণযোগ্যতার উপর ভিত্তি করে ছত্রাক সাধারণত দুই প্রকার, যথা- খাওয়ার উপযোগী ছত্রাক ও খাওয়ার অনুপযোগী ছত্রাক। সহজ ভাষায় মাশরুম ও ব্যাঙের ছাতার মধ্যে পার্থক্য হলো- যেসব ছত্রাক খাওয়ার উপযোগী সেগুলো মাশরুম, অন্যদিকে যেসব ছত্রাক খাওয়ার অনুপযোগী সেগুলোকে আমরা ব্যাঙের ছাতা বলে থাকি।
প্রাচীন মিসরীয়রা মাশরুমকে দেবতার খাদ্য হিসেবে গণ্য করত। তারা মনে করত, মাশরুম খেলে তারা দীর্ঘ জীবন পাবে। চৈনিক সভ্যতায়ও মাশরুমকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ- প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ জানত, মাশরুম বিভিন্ন রোগের শক্তিশালী প্রতিষেধক। বর্তমান সময়ে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের রোগের ধরন ও ওষুধ গ্রহণের প্রবণতার পরিবর্তন ঘটে, যা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে। এ নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা পুনরায় এসব প্রাকৃতিক মেডিসিনের দিকে মনোযোগী হয়েছেন।
বাংলাদেশে মাশরুম নিয়ে গবেষণা কেন জরুরি: বাংলাদেশে মাশরুম চাষের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দুঃখজনক বিষয় এটি এখনো স্থায়ী বড় কোনো কৃষিশিল্পে পরিণত হয়নি। বাংলাদেশে মাশরুম নিয়ে কাজ শুরু করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর আশির দশকের দিকে। আজ মাশরুম সম্পর্কে আমরা যা জানি তা মূলত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো- কোনো পণ্যকে শিল্পাকারে নিতে হলে দরকার আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার- অর্থাৎ উন্নত গবেষণা, যা আমাদের নেই। তাই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর অনেক দিন ধরে কাজ করে গেলেও অপর্যাপ্ত ও সিস্টেমেটিক গবেষণার অপ্রতুলতার কারণে দৃশ্যত এর অগ্রগতি অনেক কম।
২০২৪ সালের গবেষণার তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে মাশরুম উৎপাদনের শীর্ষ দেশ চীন, পাশের দেশ ভারতও উৎপাদনের দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছে। এসব দেশের উৎপাদন সক্ষমতা দেখলে আমরা দেখি সাবস্ট্রেটের বায়োলজিক্যাল সক্ষমতা (Biological efficiency) মোটামুটি ১৫০ থেকে ২০০ শতাংশ, অথচ আমাদের দেশে তা ৫০-৬০ শতাংশের মধ্যে। এই সক্ষমতা কমের মূল কারণ হলো- ভালো জাতের অভাব ও একই সাথে বিজ্ঞানসম্মত উন্নত চাষপদ্ধতির অভাব। গরম প্রধান আমাদের দেশে যেসব মাশরুম চাষ হয় তা সবই বাইরে থেকে আনা মূলত শীতকালীন চাষযোগ্য জাত। আমাদের গরমে চাষযোগ্য মাশরুমের ভালো কোনো জাত নেই। অথচ দেশের আবহাওয়ায় চাষোপযোগী অসংখ্য মাশরুম আমাদের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে, এমনকি আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত এসব মাশরুম খেয়ে থাকে। এসব জাত সংগ্রহ করে এনে চাষপদ্ধতি উন্নতকরণ ও বর্তমানে জনপ্রিয় চাষযোগ্য মাশরুমের সাথে শঙ্কর করতে হবে। তাই মাশরুমের জাত উন্নয়নের গবেষণায় জোর দেয়া অতীব জরুরি।
আমার গবেষণা টিম কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে হবিগঞ্জ সাতছড়ি ফরেস্ট থেকে কয়েকটি জাত সংগ্রহ করে এর চাষপদ্ধতি উন্নতকরণ ও প্রোটোপ্লাস্ট ফিউশন পদ্ধতিতে জাত উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের উদ্ভাবিত ও সংগ্রহকৃত জাতগুলো গরম সহনশীল। এ জাতগুলো সারা দেশে সম্প্রসারণ করা গেলে সারা বছর মাশরুম সহজলভ্য হবে এবং দামও কম হবে। মাশরুমের জাত উন্নয়নের এ কাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দরকার বড় প্রকল্প সহায়তা ও আরো গবেষক টিম।
আমরা জানি, মাশরুম অত্যন্ত পচনশীল একটি সবজি। তাই এর সংরক্ষণ, প্যাকেজিং পদ্ধতি ও পরিবহনব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত এবং উন্নত হওয়া অতীব জরুরি, যা আমরা বর্তমানে বাজারজাত করার সময় অনুসরণ করি না। এমনকি এ সমস্যা কিভাবে উত্তরণ করা যায় এ নিয়েও কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না। একইভাবে নেই এর বাজারজাতকরণের সুনির্দিষ্ট কোনো পলিসি, নেই কোনো সুসংগঠিত বাজারব্যবস্থা। বাংলাদেশে মাশরুম মূলত ছোট ও মাঝারি কুটিরশিল্প আকারে চাষ হয়। এ ধরনের চাষিরা দেশব্যাপী বড় স্থায়ী বাজার সৃষ্টি করতে পারেন না। তাই মাশরুমের স্থায়ী বাজার সৃষ্টি করতে হলে মাশরুমভিত্তিক বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বশেষে বলতে চাই, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ ও সর্বস্তরের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণে শিল্পাকারে মাশরুম চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই মাশরুমের উন্নয়নে কার্যকর গবেষণায় সরকারকে মনোযোগী হতে হবে, দিতে হবে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এই গবেষণাকাজে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : মাশরুম গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক ডিপার্টমেন্ট অব লাইফ সায়েন্স, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
[email protected]