ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের দুঃস্বপ্ন

বর্তমান সরকারকে শুধু নির্বাচনের জন্য জনগণ আনেনি। সংস্কার, বিচার ও পরে নির্বাচন করাই জন-আকাক্সক্ষা। যেহেতু সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দ্বিমত দেখা যাচ্ছে এবং তারা কোনো সমাধানে আসছে না। এ ক্ষেত্রে যেহেতু জনগণই সব ক্ষমতার মালিক, তাই বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য জনগণের কাছেই যেতে হবে। আর জনগণের ফয়সালার একমাত্র পথ হচ্ছে রেফারেন্ডামে যাওয়া। বড় রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়গুলোর ওপর জনগণের দোহাই বা এখতিয়ারের বয়ান দিয়ে থাকে কিন্তু তারা রেফারেন্ডামে যেতে চায় না। যেহেতু সংসদ নেই, নির্বাচিত সরকার নেই- তাই জনগণই একমাত্র সমাধান। সেপথেই ইউনূস সরকারকে হাঁটতে হবে।

দীর্ঘ ১৫ বছর সাত মাস আমাদের দেশে স্বৈরচারী দুঃশাসন চলেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মীকে কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পলায়নের পর নতুন করে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। অনেকের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ বড় বড় ব্যাংক লুটেরাদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। ইটিভি হাতে নেয়া, সামিট গ্রুপ হাতে নেয়া, বসুন্ধরা গ্রুপে অবস্থান নেয়া আজ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হতে যাচ্ছে। বিশেষ কোনো একটি দল ক্ষমতায় এলে ব্যাংক লুটেরাদের স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশের সুযোগ অবারিত হয়ে পড়বে। সম্ভাব্য ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের ভয়ে প্রশাসন আজ তটস্থ। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া পরবর্তী সরকার কী হবে তা বুঝতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাওয়ার দরকার নেই। ২০২৫ সালের ৯ জুন পর্যন্ত এ বছর ৬৮টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৮টি হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত একটি বড় দল ও এর অঙ্গসংগঠন। নানা অনৈতিক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে ওই দলটি সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন ছিল মূলত কোটাপ্রথা সংস্কার নিয়ে। কিন্তু চীন সফর শেষে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেয়া, ওবায়দুল কাদেরের ছাত্রদের মোকাবেলা করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলা ও গণপিটুনিই ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। ১৬ জুলাই ২০২৪ গণহত্যা শুরুর পর থেকে রাজনীতি নতুন অবয়ব পেতে থাকে। তখনই শুরু হয় শেখ হাসিনার পতনের এক দফাভিত্তিক আন্দোলন। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা রাস্তায় নেমে আসে এবং অকাতরে জীবন দিতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত গণমাধ্যম থেকে প্রায় এক হাজার ১০০ লাশের নাম পাওয়া যায়। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম অজ্ঞাতনামা এক হাজার ১৫টি লাশ দাফন করেছে। এ ছাড়াও অজ্ঞাত আরো ৪৩টি লাশের তথ্য পাওয়া যায়। অন্য দিকে শেখ হাসিনা ও তার লোকজন দাবি করছে, সাড়ে তিন হাজার পুলিশ মারা গেছে। আর পুলিশ সদর দফতর বলছে, নিহত পুলিশের সংখ্যা ৪৪। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বক্তব্য ভিত্তিহীন ধরে নিলেও নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ২০২।

শেখ হাসিনার ৫ আগস্ট পতনের পর ৮ আগস্ট সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামত অনুসারে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দাবি শুরু হয় সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের। ড. ইউনূসের সরকারের জন্য কিন্তু কোনো মেয়াদকাল নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না যে, তা ৯০ দিন কার্যকর থাকবে। তা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখনো সংবিধানে সংযোজন করা হয়নি। মূলত জন-আকাক্সক্ষা অনুসারে তিনি সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন আয়োজন করবেন। প্রফেসর ইউনূসের দায়িত্ব পালনে যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলো ঝামেলা করছে তাতে ভবিষ্যতে কোনো ভদ্রলোক এই পদে আসতে সম্মত হবেন কি না সন্দেহ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা দেশের সূর্যসন্তান। তাদের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল না। বিএনপি সাড়ে ১৫ বছর আন্দোলন করে কিছুই করতে পারেনি। এমনকি তাদের নিরপরাধ নেত্রীকে মুক্ত করতে পারেনি। এসব ছাত্রই শেষ হাসিনাকে তাড়িয়েছে এবং খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেছে, তারেক জিয়া খালাস পেয়েছেন। এ জন্য ছাত্রদের প্রতি বিএনপির যে ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা থাকার কথা ছিল তার সামান্যই দৃশ্যমান। সরকারের বিভিন্ন অবস্থানে নিজেদের পছন্দের লোক বসানোর জন্য বিএনপি সরকারের ওপর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। তাতে সরকার বা প্রশাসনে ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। বিএনপি বারবার বলছে, সংস্কার করবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এটি এখন তাদের একমাত্র রাজনীতি। অথচ বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। বর্তমান সরকার সংস্কারের বিষয় সামনে আনলে তারা নানাভাবে বাগড়া দিচ্ছে। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সমস্যা হলো, এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা ঘুরপাক খাওয়া। এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান এটিই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ক্যান্সার। এই ক্যান্সারের চিকিৎসা কোনো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সম্ভব নয়। একটি নিরপেক্ষ সরকারই কেবল এ কাজ সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে থাকা রাজনৈতিক দলের সমর্থিত উপদেষ্টারা সুকৌশলে সংস্কারের বিষয়ে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বলে অভিযোগ উঠছে নানা মহল থেকে।

রাজনৈতিক দলের চাপ, সরকারি কর্মচারীদের চাপ ও নগণ্য সংখ্যক উপদেষ্টার অপর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রফেসর ইউনূসকে দায়িত্ব থেকে চলে যেতে উৎসাহিত করেছে। একটি রাজনৈতিক দলের লোকজনের চাপে প্রশাসনের কর্মীরা তটস্থ। এ অবস্থায় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের লোকজন ব্যালট ছিনতাই, প্রতিপক্ষের লোকজনকে কেন্দ্রে আসতে না দেয়া এবং সরকারি কর্মচারীদের চাপে রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে। প্রফেসর ইউনূস যেহেতু ভীতি, অনুগ্রহ, রাগ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে কাজ করার শপথ নিয়েছেন, তাই তাকে শক্তভাবে হাল ধরতে হবে। জনগণ যেহেতু প্রফেসর ইউনূসকে এনেছে এবং তার কোনো মেয়াদ বলে দেয়নি, তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার, ৩৬ জুলাই বিপ্লবের খুনিদের বিচার ও নির্বাচন আয়োজন করবে বলে আশা করা যায়। প্রফেসর ইউনূসকে জনগণ এনেছে, তাই চলে যেতে হলে জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে তার যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার পরিচালনা একটি রাজনৈতিক কাজ, এটি পরিচালনা করতে কিছু রাজনৈতিক দক্ষ লোক দরকার ছিল সরকারে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দ্রব্যমূল্য কমেছে। এমনকি রমজানেও তেমন বাড়েনি। এখনো তা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এটি গত ২০ বছরের মধ্যে নজিরবিহীন। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে তারা সিন্ডিকেটের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় দ্রব্যমূল্য শুধু বাড়তেই থাকে। মূল্য নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের দাম পতনসহ নানা অজুহাত তুলে ধরে। এখন কিন্তু সব বৈশ্বিক সূচক মোকাবেলা করেই জিনিসপত্রের দাম কমিয়েছে। এ মুহূর্তে সব তরকারির দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। এবার কোরবানির সময় মসলার দাম অকল্পনীয় কম অঙ্কের মধ্যে আছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা ও সংস্কৃতি থেকে ড. ইউনূস দেশকে ফিরিয়ে এনেছেন। পোর্ট, করিডোর নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারণা নিছক উদ্দেশ্যমূলক। এ আলোচনা ভবিষ্যৎ সিন্ডিকেটের পথ সুগম করার পাঁয়তারা কিনা এমন সন্দেহ অনেকের। সীমান্তে যখন মানুষ হত্যা করা হয়, তখন বড় রাজনৈতিক দলের মুখ অজ্ঞাত কারণে বন্ধ থাকে। কিন্তু প্রফেসর ইউনূসই ভারতকে অঙ্গুলি দেখিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করেছেন। ভারত যেখানে একচেটিয়া ব্যবসায় করত সেখানে বিকল্প পথ বের করেছে বর্তমান সরকার। এ জন্যই দ্রব্যমূল্য নিম্নমুখী হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকব্যবস্থা যারা ধ্বংস করেছে সেই ব্যক্তিদের কাছে রাজনৈতিক দলের বিশেষ ব্যক্তিরা আনুকূল্য গ্রহণ ও তাদের পরিবারের লোকজন ওই বিতর্কিত ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে।

মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকারকে শুধু নির্বাচনের জন্য জনগণ আনেনি। সংস্কার, বিচার ও পরে নির্বাচন করাই জন-আকাক্সক্ষা। যেহেতু সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দ্বিমত দেখা যাচ্ছে এবং তারা কোনো সমাধানে আসছে না। এ ক্ষেত্রে যেহেতু জনগণই সব ক্ষমতার মালিক, তাই বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য জনগণের কাছেই যেতে হবে। আর জনগণের ফয়সালার একমাত্র পথ হচ্ছে রেফারেন্ডামে যাওয়া। বড় রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়গুলোর ওপর জনগণের দোহাই বা এখতিয়ারের বয়ান দিয়ে থাকে কিন্তু তারা রেফারেন্ডামে যেতে চায় না। যেহেতু সংসদ নেই, নির্বাচিত সরকার নেই- তাই জনগণই একমাত্র সমাধান। সেপথেই ইউনূস সরকারকে হাঁটতে হবে।