শহীদ জিয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন

শহীদ জিয়ার সততা ছিল কিংবদন্তিসম। মেধা ও দক্ষতা ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল বিরল। প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির ক্ষণজন্মা মানুষটি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছেন। আর সেজন্য তার শাহাদতের পর প্রায় ২০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়

শহীদ জিয়াউর রহমান
শহীদ জিয়াউর রহমান |ছবি : সংগৃহীত

১৯৩৬ সালে বগুড়ার বাগবাড়ি গ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্ম। ১৯৫৩ সালে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে লাহোরের খেমকারান সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। ১৯৬৬ সালে কুয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসপি উপাধিতে ভূষিত হন। একই সাথে তিনি কাকুলাস্থ তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক একাডেমির ইন্সট্রাক্টর নিযুক্ত হন। তিনি ছাত্রজীবন থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন লালন করতেন। তার লালিত স্বপ্নের কথা আমরা শহীদ জিয়ার নিজের লেখা পড়ে জানতে পারি। সেই তিনি ২৬ মার্চ রাতে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি ঢাকার জয়দেবপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ছিলেন। জয়দেবপুরের বিক্ষোভ ঘিরে সারা দেশে গণবিক্ষোভের দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। জিয়াউর রহমান ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলাদেশের চট্টগ্রামসংলগ্ন সেক্টরে সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান একটি অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান চরম ক্রান্তিকালে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করে পুনঃগঠনের মাধ্যমে নবধারার রাজনীতির সূচনা করে। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের জন্য স্থায়ী আসন তৈরি করে নিতে পেরেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেখানে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে জিয়াউর রহমান দেশ ও জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। হতাশার অন্ধকার থেকে আশার আলোতে নিয়ে গেছেন।

১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ যখন গণতন্ত্র হারিয়েছিল, কথা বলার, মতামত প্রকাশের অধিকার, সংগঠন করার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়েছিল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল, তারপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে জিয়াউর রহমান ফিরিয়ে আনেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে তিনি এদেশের মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তিনি শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনার প্রথম ধাপ হিসেবে দলিলপত্র সংগ্রহের প্রকল্প হাতে নেন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এ দেশের সাধারণ সিপাহি-জনতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষায় জিয়াকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। তিনি সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। সব দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্র করে উদার গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণের কাজ শুরু করেন।

‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শনের প্রবক্তা এ নেতা বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে নগরে ছুটে বেরিয়েছেন মানুষকে উৎপাদন উন্নয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্তির লক্ষ্যে। বাংলাদেশের মানুষ নতুন নেতৃত্বে আশার আলো দেখতে পায়। ক্ষেতে খামারে কৃষক উৎপাদনের কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানায় শ্রমিকরা ২-৩ শিফটে কাজ করেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ায় মন দেন। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যে ভরে ওঠে কৃষকের উঠোন। শিল্পে নতুন বিনিয়োগের সূচনা হয়। খালখনন কর্মসূচি, কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, গণশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, যুবকদের সংগঠিত করা, আজকের পোশাক শিল্পের সূচনা তিনি করেন।

বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ থেকে মুক্ত করে একটি সম্ভাবনাময় উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন অতিস্বল্প সময়ে। জিয়ার প্রজ্ঞাসম্পন্ন, দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানকে পরাজিত করে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধের অবসানে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে প্রকৃত বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এর স্বীকৃতি হিসেবে তুরস্ক, আলজেরিয়া, মরক্কো ও মালিতে জিয়াউর রহমানের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়।

দক্ষিণ এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনীতি সচল করতে তিনি সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেন, আজ তার ফলে সার্ক এখন একটি বাস্তবতা।

দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের, এ মহান নেতাকে আমরা বেশি দিন আমাদের মাঝে রাখতে পারিনি। বাংলাদেশের শত্রুরা তাকে ১৯৮১ সালে ৩১ মে চট্টগ্রামে হত্যা করে। তার চলে যাওয়ায় বাংলাদেশের অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

শহীদ জিয়ার সততা ছিল কিংবদন্তিসম। মেধা ও দক্ষতা ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল বিরল। প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির ক্ষণজন্মা মানুষটি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছেন। আর সেজন্য তার শাহাদতের পর প্রায় ২০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এই মহান নেতৃত্বকে জনগণের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে হেয়প্রতিপন্ন করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বিগত ফ্যাসিবাদী জমানায় আদালতের রায়ে, মিথ্যা প্রচারণায়, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে সৎ, ত্যাগী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই নেতাকে মুছে ফেলতে অপচেষ্টা চালায় আওয়ামী বাকশালীরা। কিন্তু যার স্থান মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী তাকে মুছে ফেলা যায় না। এদেশের স্বাধীনতাকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষ যত দিন বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উড়াবে ততদিন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

লেখক : কলামিস্ট, ৯০-এর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা