পুরনো বিমানে প্রশিক্ষণ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা

‘সময়ের সাথে প্রযুক্তি বদলায়, যুদ্ধের কৌশল বদলায়, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— মানুষের জীবনের মূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা কি সেই গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছি?’

অধ্যাপক ডক্টর দিপু সিদ্দিকী

একটি মৃত্যু আমাদের থমকে দেয়। আরেকটি মৃত্যু প্রশ্ন জাগায়। কিন্তু বারবার মৃত্যু ঘটলে, তা আর কাকতালীয় দুর্ঘটনা নয়— সেটা দায়িত্বহীনতার ফল, অবহেলার প্রতিচ্ছবি এবং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার নির্মম পরিণতি।

স্কোয়াড্রন লিডার তৌকির ইসলাম সাগরের করুণ মৃত্যুর খবর আমাদের হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ৯ মে ২০২৪ সালে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ একটি যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ প্রশিক্ষণ বিমানে প্রাণ হারান। তিনি মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তেও শতশত মানুষের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আরেকটি মূল্যবান প্রাণ ঝরে গেল একইভাবে। এবারো কারণ— সেই পুরনো, ভাঙাচোরা, প্রশিক্ষণের অযোগ্য বিমান।

এই মৃত্যু কি শুধুই একটি দুর্ঘটনা? নাকি এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা?

বাংলাদেশে এখনো ৬০ ও ৭০ দশকের চাইনিজ রেপ্লিকা বিমান দিয়ে পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অথচ এসব বিমান উন্নত দেশগুলো বহু আগেই বাতিল করেছে। কেন? কারণ, সময়ের সাথে প্রযুক্তি বদলায়, যুদ্ধের কৌশল বদলায়, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— মানুষের জীবনের মূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা কি সেই গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছি?

প্রশিক্ষণ বিমানের মান এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। পাইলটদের পরিবার, সহকর্মী এবং সাধারণ মানুষ বারবার দাবি তুলেছেন— বিমানগুলো অনুপযুক্ত, ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সেই সব দাবিকে বারবার ধামাচাপা দেয়া হয়েছে ‘তদন্ত চলছে’, ‘ত্রুটির জন্য দুঃখিত’, ‘পরিবারকে ক্ষতিপূরণ’— এসব চেনা প্রতিক্রিয়া দিয়ে।

তবে এবার আর শুধু পাইলটের জীবন নয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে। উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীরা তখনো জানত না, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানটি কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের জন্য মৃত্যুবরণ বয়ে আনবে। একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিস্ফোরিত হয়ে স্কুলের ওপর আছড়ে পড়লে অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন, অনেকে প্রাণ হারান।

এই ঘটনাগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। এগুলো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় ফাঁক, দুর্বল তদারকি এবং দীর্ঘদিনের অবহেলার ফল।

আমরা যাদের হাতে আকাশের দায়িত্ব তুলে দিচ্ছি, যারা দেশের আকাশসীমা রক্ষা করবেন, তাদের কি আমরা একটি নিরাপদ প্রশিক্ষণ পরিবেশ পর্যন্ত দিতে পারি না? এই প্রশ্ন শুধু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়, এটি আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন।

একটি জাতি তখনই দুর্বল হয়, যখন তার তরুণেরা নিজেদের জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। যখন মেধাবীরা রাষ্ট্রের অবহেলায় মৃত্যুর মুখে পড়ে। আমরা কিভাবে আশা করবো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে, যদি তারা দেখে রাষ্ট্র নিজেই তাদের জীবন নিয়ে গাফিল?

সরকার প্রতিবছর প্রতিরক্ষা খাতে বড় অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ করে। তাহলে কেন এখনো এইসব পুরনো বিমানের আধুনিকায়নের নামে ‘রং করে’, ‘পার্টস বদলে’ এগুলোকে উড়ানোর চেষ্টা চলে?

এই বাজেট কি কেবল ফাইলচালনা আর অনিয়মের শিকার?

আমরা যদি পাইলটদের মৃত্যু থেকে শিক্ষা না নিই, তাহলে শুধু আরো মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকবো। প্রশ্ন উঠছে— একটি রাষ্ট্রের পক্ষে আর কতজন পাইলট হারানো সম্ভব?

সরকারের উচিত অবিলম্বে পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা।

ক. স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন: প্রতিটি প্রশিক্ষণ বিমানের সার্বিক অবস্থা যাচাই করতে হবে। কারিগরি, প্রযুক্তিগত এবং নিরাপত্তা মানদণ্ড বিবেচনা করে উপযুক্ততার মূল্যায়ন করা জরুরি।

খ. অনুপযুক্ত বিমান বাতিল: যেসব বিমান ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোকে রিসাইক্লিং কারখানায় পাঠানো হোক।

গ. নতুন প্রশিক্ষণ বিমান কেনা: সময়োপযোগী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং নিরাপদ প্রশিক্ষণ বিমানের প্রয়োজনীয়তা আজ আর বিলাসিতা নয়— এটি জাতীয় নিরাপত্তার পূর্বশর্ত।

ঘ. পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো: নিহত পাইলটদের পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের দায় কেবল ক্ষতিপূরণে সীমাবদ্ধ নয়, তাদের সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

ঙ. নির্বাহী ও বাজেট পর্যায়ে জবাবদিহি: প্রতিটি মৃত্যু তদন্তের শেষে উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তদাতাদের দায় নির্ধারণ করতে হবে।

আমরা আর চুপ থাকতে পারি না। প্রতিটি নাগরিকের এখন দায়িত্ব— প্রশ্ন তোলা, প্রতিবাদ করা, রাষ্ট্রকে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো। এটা শুধু একটি বাহিনীর প্রশ্ন নয়— এটা আমাদের জাতীয় সক্ষমতা, মানবিক মূল্যবোধ, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার প্রশ্ন।

আজ একজন পাইলটের মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করেছে। কাল হয়তো এই অবহেলার বলি হবে আরেকজন। সময় এসেছে, আমরা চুপ থাকা ছেড়ে দিই। চুপ থাকা মানেই মেনে নেয়া। আর মেনে নেয়া মানেই আরো মৃত্যুর প্রস্তুতি।

আমরা আর মেনে নিতে রাজি নই।

এবার ব্যবস্থা নিন।

জবাব দিন।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক এবং কলা অনুষদের ডিন, রয়েল ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা।