“মানবিক মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা ও সুশাসন : টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একটি বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা”—গুরুগম্ভীর লাগে, তাই না? অথচ ভেতরের কথাগুলো আসলে সোজাসাপ্টা, একেবারে হাড়ে গেঁথে থাকা ব্যথার মতো সত্য।
শুরুতেই “শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড”—এই পুরনো বুলি। সত্যি বলতে, এটা শুধু মুখে বলার জন্য নয়। মেরুদণ্ড নেই, মানুষ দাঁড়াতে পারে? পারে না। জাতিও পারে না। স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা—সবই আছে। কিন্তু স্বাধীনতা মানে তো শুধু একটা জমি না, মানচিত্র না, ঠিক? স্বপ্ন ছিল ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক, বৈষম্যহীন একটা সমাজ। আর বাস্তব কী? স্বপ্নটা এখনও সিনেমার মতোই দূরে। কারণ? একটাই—মূল্যবোধহীন, গোঁড়ামোতে ভরা, দলবাজিতে ঠাসা শিক্ষা ব্যবস্থা।
ডিগ্রি দিয়ে কী হবে, বলো? শুধু কাগজের সার্টিফিকেট না, দরকার হচ্ছে মাথার ভেতরের আলো। John Dewey-এর কথা আবার মনে পড়ল—“Education is life itself.” জীবন মানে তো কেবল গাছাড়া পড়া না।
দুই দশক ধরে শিক্ষকতা আর গবেষণা করে আসছি। কখনও কখনও মনে হয়, আমরা আসলে কার জন্য পড়াই? চাকরির যন্ত্র বানাতে নাকি চিন্তাশীল, মানবিক মানুষ বানাতে? এটাই তো আসল প্রশ্ন।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা—বস্তুত, শুধু দালান-কোঠা, ইন্টারনেট আর জিডিপি বাড়লেই সমাজ বদলায় না। ভেতরের শিক্ষা যদি কঙ্কাল হয়ে থাকে, তাহলে বাইরের চাকচিক্য দিয়ে কী হবে? আমাদের শিক্ষা এখন রোবট বানায়, মানুষ না।
আচ্ছা, অ্যারিস্টোটলের ওই বিখ্যাত লাইনটা মনে আছে? “The educated differ from the uneducated as much as the living from the dead.” স্কুল-কলেজে মুখস্ত করতাম একসময়—কিন্তু কথাটার ওজন? শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের পার্থক্য মানে, সত্যিই, একদম আকাশ-পাতাল।
একটা শিক্ষিত সমাজ পারে দুর্নীতি, সহিংসতা, গোঁড়ামির মতো রোগের ওষুধ হতে। আর এই শিক্ষা শুধু নম্বর না, দায়িত্ববোধ আর বিবেকের প্রশ্ন। দুঃখের কথা, আমাদের পাঠ্যবই-নির্ভর শিক্ষায় এসব নেই বললেই চলে।
কী হয় তখন? ছোটরা স্কুলে নৈতিকতা শেখে না, শুধু নম্বরের দৌড়ে ব্যস্ত। ফলে ভবিষ্যতের নেতৃত্বে শূন্যতা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সবখানে মূল্যবোধের অবক্ষয়। শেষে কী দাঁড়ায়? সমাজ হয় দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থপর, অসহিষ্ণু।
কাগজে-কলমে রাষ্ট্র হয়তো চলছে, কিন্তু আসল শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। আইন মানা তো দূরের কথা, ন্যায়বোধই হারিয়ে যাচ্ছে।
গণতন্ত্র নিয়েও দেখি সবাই মুখে ফেনা তুলছে। “Democracy is the government of the people, by the people, for the people.”—লিঙ্কনের সেই বিখ্যাত উক্তি। কিন্তু গণতন্ত্র কি শুধু ভোট? নাকি দায়িত্বশীল আচরণ? অধিকারের সাথে কর্তব্যও তো আছে, সেটা কয়জন মানে? আমাদের দেশে গণতন্ত্র মানেই যেন ভোটের খেলা—মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, এসব থাকলেই না গণতন্ত্র সত্যিকারের হয়।
আর সুশাসন? এসব আবার কাগজে পড়ে ভালো লাগে, বাস্তবে দেখি না। ম্যান্ডেলার ওটা—“Education is the most powerful weapon…”—ঠিকই বলেছে বেটা। শিক্ষা যদি মানবিক, নৈতিক না হয়, তাহলে সে আর অস্ত্র কী!
সুশাসনের জন্য দরকার স্বাধীন প্রশাসন, নিরপেক্ষ বিচার, দায়িত্ববান মিডিয়া, মুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর টেকসই উন্নয়ন? এসডিজি-ফেসডিজি যতই বলো, যদি মানুষ মানবিক না হয়, পরিবেশ-সচেতন না হয়, তবে কিচ্ছু টিকবে না। শুধু টাকার পাহাড় গড়লে কী হবে, মানুষের জীবন বদলাবে না।
গণতন্ত্র? সেটা কিভাবে আসবে? আমার মতে:
১. দলনিরপেক্ষ, দায়িত্ববান শিক্ষা—যা সত্যিকারের মানুষ বানাবে।
২. অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি—যেখানে তরুণরা স্বাধীনভাবে ভাবতে পারবে, প্রশ্ন করতে পারবে।
৩. জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান—দলীয় নিয়ন্ত্রণ নয়, জনগণের কল্যাণ।
৪. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—সহনশীলতা, সংলাপ, সমঝোতা।
Victor Hugo-এর লাইনটা দারুণ—“He who opens a school door, closes a prison.” একেবারে খাঁটি কথা। স্কুল মানেই শুধু বই না, অপরাধ কমানোর কারখানা।
সবচেয়ে বড় কথা, পরিবারে যদি নৈতিকতা, সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেমের বীজ বোনা যায়, তখনই সমাজ বদলাবে। স্কুলের কাজ শুধু সিলেবাস না, প্রশ্ন করা শেখানো—এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো।
সবশেষে বলি—বাংলাদেশের যত সমস্যা—দুর্নীতি, বৈষম্য, কুসংস্কার, সহিংসতা—এর একটাই প্রতিকার, মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা। শিক্ষা যদি শুধু চাকরির টিকিট হয়, তাহলে হয়তো অর্থনীতিতে এগোব, কিন্তু হৃদয়শূন্য একটা ভবিষ্যৎ পাবো।
আজ দরকার এমন শিক্ষা, যা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখায়, আর বুকে মূল্যবোধ বয়ে বেড়াতে শেখায়।
এতটাই সহজ—আর এতটাই কঠিন।
লেখক: ডিন, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা , কবি ও প্রাবন্ধিক।