গাজায় চলমান মানবিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ইসরাইল এবং তার সহযোগী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বয়কট আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এই আন্দোলন এখন আর কেবল আবেগ বা সাময়িক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এর সমর্থনে শক্তিশালী নৈতিক কর্তব্যবোধ এবং সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সচেতন ভোক্তারা এখন কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং ব্যবসায়িক নীতির গভীরে গিয়ে তাদের ক্রয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
‘মানবিকতা-বিধ্বংসী’ কৌশলের অভিযোগ
বয়কট আন্দোলনের প্রবক্তারা অভিযোগ করছেন, কিছু বহুজাতিক কোম্পানি ফিলিস্তিনের দখলকৃত ভূমিতে ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, এসব কোম্পানি সংঘাত থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন করছে এবং পরবর্তীতে সামাজিক দায়বদ্ধতার (CSR) নামে সামান্য কিছু অনুদান দিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করছে। এই দ্বিমুখী নীতিকে তারা ‘মানবিকতা-বিধ্বংসী’ কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, কোনো ব্র্যান্ডের আসল পরিচয় তার পণ্য নয়, বরং তার নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। যেসকল প্রতিষ্ঠান গণহত্যায় অভিযুক্ত কোনো পক্ষকে সমর্থন করে, তাদের পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে ভোক্তারাও পরোক্ষভাবে সেই অন্যায়ের অংশীদার হন বলে মনে করছেন আন্দোলনকারীরা।
অর্থনৈতিক পাল্টা যুক্তি: চাকরি হারানোর ভয় বনাম নতুন সম্ভাবনা
বয়কটের বিরুদ্ধে একটি প্রচলিত যুক্তি হলো, এর ফলে স্থানীয় কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে, অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ এই যুক্তিকে একপেশে বলে মনে করছেন। তাদের মতে, কোনো নির্দিষ্ট বিদেশি কোম্পানির পণ্য বর্জন করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু মানুষ চাকরি হারাতে পারেন, কিন্তু এর ফলে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ইতিবাচক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এই বিশ্লেষকদের মতে, বয়কটের ফলে বিদেশী কোম্পানির ওপর নির্ভরতা কমে এবং দেশীয় শিল্পের জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি হয়। যখন ভোক্তারা স্থানীয় পণ্য কেনা শুরু করেন, তখন সেই অর্থ দেশের অর্থনীতিতেই থেকে যায়। এতে স্থানীয় উদ্যোক্তারা লাভবান হন, নতুন কারখানা স্থাপিত হয় এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। পুঁজি এক জায়গা থেকে সরে গিয়ে নতুন এবং সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগ হয়, যা অর্থনীতির জন্য একটি গতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে।
আমদানি-বিকল্প নীতির ঐতিহাসিক সাফল্য
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রাথমিক পর্যায়ে আমদানি-বিকল্প নীতি গ্রহণ করেছিল। তারা বিদেশী পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করেছে, যা তাদের দেশীয় শিল্পকে শক্তিশালী করে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে বিশ্বের প্রধান রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে।
অর্থনীতিবিদ হা-জুন চ্যাং তার ‘ব্যাড সামারিটান্স: দ্য মিথ অফ ফ্রি ট্রেড অ্যান্ড দ্য সিক্রেট হিস্টরি অফ ক্যাপিটালিজম’ বইয়ে দেখিয়েছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় একটা সময় বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট পান করাকে ‘দেশদ্রোহী’ কাজ হিসেবে দেখা হতো। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার এই মানসিকতা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে ইসরাইল-সংশ্লিষ্ট পণ্য বয়কটের ফলে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি এবং জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভোক্তার সম্মিলিত শক্তির প্রভাব
অনেকেই মনে করেন, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন ভোক্তার বয়কট তেমন কোনো ফল বয়ে আনে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সব অথবা কিছুই না’—এই মনোভাবের পরিবর্তে ছোট এবং ধারাবাহিক পরিবর্তনও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। একজন ভোক্তা যদি এমন কিছু পণ্য দিয়ে বয়কট শুরু করেন, যার সহজলভ্য বিকল্প বাজারে রয়েছে, এবং তা সঠিকভাবে চালিয়ে যান, তবে এর সম্মিলিত প্রভাব হয় ব্যাপক।
ভোক্তাদের ক্রয় অভ্যাসের এই ছোট পরিবর্তন খুচরা বিক্রেতাদের ওপর প্রভাব ফেলে, যা পরবর্তীতে পাইকার এবং উৎপাদনকারী কোম্পানি পর্যন্ত পৌঁছায়। সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনায় এই প্রভাবকে ‘বুলহুইপ ইফেক্ট’ (Bullwhip Effect) বলা হয়, যেখানে চাহিদার একটি সামান্য পরিবর্তন সরবরাহ চেইনের উপরের স্তরগুলোতে বহুগুণে বিবর্ধিত হয় এবং কোম্পানিকে তার উৎপাদন ও সরবরাহ নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে।
মূলত, ভোক্তা বয়কট হলো একটি শান্তিপূর্ণ কিন্তু শক্তিশালী অর্থনৈতিক চাপ, যার লক্ষ্য হলো কোম্পানিগুলোকে তাদের বিতর্কিত ব্যবসায়িক নীতি পরিবর্তন করে মানবাধিকার ও নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য করা।