অবাধ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা

নাগরিকের কাছে জবাবদিহির প্রাথমিক শর্ত হলো যেকোনো দল ক্ষমতায় যেতে চাইলে অবাধ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে হবে। তাই একথা বলা যায়, আমাদের দেশের মানুষ তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে আগামীতে দেশে কী ধরনের সংস্কার দরকার

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ৫৩ বছরের শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের মধ্যে পেন্ডুলামের মতো ঝুলেছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে একাধিকবার ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উত্থান ঘটে। শেখ হাসিনার গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসন কর্তৃত্ববাদের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে।

বাংলাদেশে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের আমলে আমরা একাধিকবার ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের উত্থান দেখেছি। নির্বাচিত বেসামরিক শাসনের সময়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ও ভঙ্গুর ছিল। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, জাতীয় সংসদের অকার্যকারিতা। যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তারা সংসদে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এমনভাবে ব্যবহার করেছে, যাতে সংসদ শুধু ক্ষমতাসীন দলের আইনি বৈধতা প্রদানের জায়গায় পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সীমাহীন ক্ষমতার প্রয়োগ, প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদের গুরুত্ব হ্রাস, নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার দিকে ক্রমাগত পক্ষপাত, বিরোধী মত দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্ন ব্যবহার এবং সিভিল সোসাইটি দলীয়করণে জবাবদিহির সুযোগ হ্রাস ইলেক্টোরাল ডেমোক্র্যাসির গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। একে এক ধরনের আধা কর্তৃত্ববাদী রূপ দেয়।

যেহেতু একটি অবাধ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা বহাল ছিল এবং প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েনি, সেহেতু ১৯৯১ সালে, বিশেষত ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের শাসনকে নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদী বলে চিহ্নিত করা যায়। ১৯৯১-২০০৬ পর্বে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ভেতরে সম্পর্কেরও ব্যাপক অবনতি ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৬ সালের শেষ দিকে দুই পক্ষ পরস্পরের মুখোমুখি হয়। এতে করে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনা-সমর্থিত একটি সরকার ক্ষমতা দখল করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রশ্নাতীতভাবে পদসোপান মেনে নেয়ার ধারা এবং বাংলাদেশী রাজনীতির নিও-প্যাট্রিমোনিয়াল চরিত্র, যার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভ দলের ভেতরে তার অবস্থান দৃঢ় করে, যা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভেতরে পেট্রোমোনিয়াল সম্পর্ক ব্যাপ্ত করে দেয়।

নিও-পেট্রোমোনিয়াল শাসনব্যবস্থায়, প্রধান নির্বাহী যতদূর সম্ভব সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। ক্ষমতা প্রয়োগ জনসেবার রূপ হিসেবে নয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির রূপ হিসেবে। মতাদর্শ বা আইনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে। ফলে অন্যদের সাথে সম্পর্কটি হয় প্রভু ও খদ্দেরের, এ সম্পর্ক এমনভাবে সাজানো হয়, যেন তা আনুষ্ঠানিক বা সরকারি দায়িত্ব পালনের বিষয় প্রতিফলিত করে না, করে উভয়ের ব্যক্তিগত মর্যাদা।

কিন্তু ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফেরেন, তত দিনে রাজনৈতিক দৃশ্যপট লক্ষণীয়ভাবে বদলে যায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে তিক্ততা হিংসায় রূপ নেয়। এর কারণ, রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে নির্বাসিত করতে ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যর্থ চেষ্টা। তথাকথিত মাইনাস টু ফর্মুলায় হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়কে নির্বাসিত করার কথা বলা হলেও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের যেকোনো আশঙ্কা নির্মূলের ক্ষমতা হাসিনার হাতে এসেছিল।

রাজতন্ত্রে রাজা সব কিছুর ঊর্ধ্বে থাকেন। আইন বা প্রতিষ্ঠান তাকে স্পর্শ করে না, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে কোনো দেয়াল থাকে না; যে প্রতিষ্ঠানগুলো রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখে, সেগুলোও রাজার করতলগত থাকে। রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ এবং রাজতন্ত্রের অবসানের ইতিহাস থেকে স্পষ্ট যে, রিপাবলিকের উদ্ভব রাজার এ একচ্ছত্র ক্ষমতা সঙ্কুচিত করে বা তার অবসান ঘটায়। রিপাবলিকের ধারণা রাজতন্ত্রের বিপরীতে যে বিষয়কে প্রাধান্য দেয়, তা হচ্ছে নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ জনগণ সব ক্ষমতার উৎস। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত যে নাগরিকের সার্বভৌমত্ব জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। এ অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না, তা অন্যের হাতে সমর্পণও করা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জনগণের শাসনব্যবস্থার ধারণা থেকে বিশ্বে রিপাবলিকের বিস্তার ঘটে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আধুনিক সময়ে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার যুগের সূচনা হয়।

রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে সব প্রতিষ্ঠান ছাপিয়ে ব্যক্তি নিজে যেন রাষ্ট্র না হয়ে ওঠে। কিন্তু আধুনিক যুগের প্রথম রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ২৩২ বছর পরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন রূপে এমন শাসনব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে চলেছে, যেখানে রাষ্ট্র ব্যক্তির করায়ত্ত হয়ে পড়ছে। নাগরিকের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে শাসনের অনেক উদাহরণ ইতিহাসে আছে।

শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশের কথা বিবেচনায় নিলেও দেখবো, নাগরিকদের সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে এ আশা তৈরি হয় যে, যারা দায়িত্বে আসীন হয়েছেন, তারা পুরনো ব্যবস্থা এমনভাবে বদলে ফেলবেন যেন নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার স্থায়ী অবসান ঘটে। এ ধরনের পরিবর্তনের আকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয় সাধারণত স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের অপসারণ ঘটলে।

গত কয়েক দশকে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে। এসব অভ্যুত্থান ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং তা ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসককে অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছে। রাষ্ট্রকাঠামো বদলের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এ আশাবাদ পূরণ হয়নি; কিন্তু জন-আকাক্সক্ষা যে ব্যাপক ছিল, তা অনস্বীকার্য। চরিত্র ও প্রকৃতি বিবেচনায় এসব আন্দোলন ষাটের দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে ছাত্র আন্দোলন হয় তা থেকে ভিন্ন; ষাটের আন্দোলনের লক্ষ্যকে এ বিবেচনায় সীমিত বলে বলা যায়। বাংলাদেশে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানও তুলনামূলকভাবে কম পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি করেছিল।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এমন আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করেছে, তা স্বৈরতন্ত্রকে সাময়িকভাবে পরাজিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নেতারা ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলেছেন। সে বিবেচনায় চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের জন-আকাক্সক্ষা হচ্ছেÑ এমন রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনব্যবস্থা যেন অব্যাহত না থাকে; যা ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র তৈরি করে; যেন কোনো ব্যক্তির আচরণের মধ্য দিয়ে এটি প্রকাশিত না হয় ‘আমিই রাষ্ট্র’। এ ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে, জনগণের স্বার্থ রক্ষায় জনগণের নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার ক্ষমতা। অর্থাৎ এটি প্রতিষ্ঠা করা যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে আইন প্রণয়ন করবেন, তা হবে সবার জন্য ন্যায্য এবং আইন শুধু কতিপয় ব্যক্তিকে সাহায্য করবে তা নয়, বরং সবাইকে সাহায্য করবে।

ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে একাদিক্রমে রিপাবলিক ও গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটলেও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। এখনো ঘটছে। এটি সাধারণভাবে বিবেচনা করা হয়, রিপাবলিক ও গণতন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক এবং অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত; সে কারণে এ দু’টি শব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রাসঙ্গিকভাবে এটিও উল্লেখযোগ্য যে, এর ব্যতিক্রম আছে, গণতন্ত্রমাত্রই রিপাবলিক হবে তা নয়। আধুনিক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের অন্যতম দেশ বলে পরিচিত যুক্তরাজ্য গণতান্ত্রিক দেশ, কিন্তু রিপাবলিক নয় সেখানে রাজতন্ত্র বহাল আছে। ইউরোপসহ অন্যান্য মহাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আছে। এগুলো নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র নয়। অন্য দিকে গত কয়েক দশকে দেখা গেছে, রিপাবলিকের মৌলিক ভিত্তি যে নাগরিক সার্বভৌমত্ব, তাকে অগ্রাহ্য করে অনেক রিপাবলিকে স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অব্যাহত থেকেছে। এ ধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থা একসময় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ ছাড়া একদলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের সাধারণ উপাদানগুলো লঙ্ঘিত হয়েছে।

স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে, বিশেষত বিংশ শতাব্দীতে যেসব স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয় ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্র নামেই রিপাবলিক। কিন্তু রিপাবলিকের যে মৌলিক উপাদান, তা ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসন এ ধরনের ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের উদাহরণ।

বাংলাদেশের নাগরিকরা এ সময় ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন, এর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। এ শাসনের অবসান ঘটেছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ৩৬ দিনের অব্যাহত আন্দোলন এবং হাজারো মানুষের সর্বোচ্চ আত্মদানের মধ্য দিয়ে। হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

এই আন্দোলনের পটভূমি হচ্ছে অভাবনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন এবং গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ ১৫ বছরের আন্দোলন। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের আন্দোলনে যেসব জন-আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটেছে, তার অন্যতম হচ্ছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর যেন স্বৈরাচার তৈরি না হয়।

এ জন-আকাক্সক্ষার বাস্তব রূপ দিতে হলে, আমাদের বোঝা দরকার, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার নতুন রূপ কী, স্বৈরাচারী শাসকদের উত্থান কিভাবে ঘটে। কিভাবে ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেয়। বাংলাদেশে আজকে যখন সবার লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ‘আবার স্বৈরতন্ত্র নয়’, সে সময়ে এ পথরেখা বোঝা দরকার দু’টি কারণে। প্রথমত, এর ঐতিহাসিক তাৎপর্যের বিবেচনা অর্থাৎ আমরা এখানে কিভাবে এলাম তা উপলব্ধি করা; দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে স্বৈরশাসকের উত্থান প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ করা।

মনে রাখা প্রয়োজন, আমরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে উত্তাল সময় পার করছি। নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এসে দাঁড়িয়েছে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। এ সম্ভাবনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও এর রাজনীতিকে ঢেলে সাজানোর সম্ভাবনা। ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের পুনরুত্থানের আশঙ্কা মোকাবেলার আলোচনায় আমাদের এ দিকটি মনে রাখা জরুরি। তবে এ সম্ভাবনার পাশাপাশি অনিশ্চয়তাও রয়েছে।

ব্যাপক পরিবর্তনের জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি হয় দুইভাবে। প্রথমত, যারা পরিবর্তনের নেতৃত্বে থাকেন আগে থেকে ধারণা দেন, তারা কী ধরনের বদল চাইছেন। পরিবর্তনের প্রক্রিয়া যা-ই হোক না কেন, তা যত দীর্ঘ বা স্বল্প হোক না কেন, নাগরিকেরা জানেন পুরনো ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বদলে যাবে, সেটি জন-আকাক্সক্ষায় রূপ নেয়। জনপ্রত্যাশা তৈরির আরেকটি পথ হচ্ছে যখন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চরম বৈষম্যমূলক, জনবিচ্ছিন্ন ও নিপীড়নমূলক হয়ে ওঠার পর তার পতন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দুর্বলতা শুধু সংসদের অকার্যকারিতা দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে বরং বিবেচনা করা দরকার গণতন্ত্রের আদর্শের উপস্থিতি এবং বাস্তবায়নের বিবেচনায়। গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শগুলো হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, জবাবদিহি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

সার্বভৌমত্ব মানে জনগণ সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। সরকার জনগণের ইচ্ছার অধীন হবে। এ ধারণা শুধু স্বৈরাচারী ক্ষমতা বা অভিজাততন্ত্রের শাসন অস্বীকার করে তা-ই নয়; বরং আইনের শাসনের দিকে ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ আইনের চোখে সবাই সমান, এটি গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। সার্বভৌমত্ব একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। সুতরাং একে কোনো দৈব ক্ষমতা, উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শের নামে জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া যাবে না।

জবাবদিহি এমন একটি ধারণা, যা এক দিকে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়; অন্য দিকে সরকারের দৈনন্দিন কাজে নাগরিকদের ভূমিকা নিশ্চিত করে। একটি টেকসই ও কার্যকর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে জবাবদিহি হচ্ছে খাড়াখাড়ি, আড়াআড়ি এবং সামাজিক। খাড়াখাড়ি জবাবদিহি হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। আবার সরকারের আড়াআড়ি জবাবদিহি তৈরি হয় আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন কিছু ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এগুলো হচ্ছে, সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত কতগুলো সংস্থা, যেমন দুর্নীতিবিরোধী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। সামাজিক জবাবদিহি হচ্ছে নাগরিকদের সংগঠনের সিভিল সোসাইটির কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা।

আর নাগরিকের কাছে জবাবদিহির প্রাথমিক শর্ত হলো যেকোনো দল ক্ষমতায় যেতে চাইলে অবাধ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে হবে। তাই এ কথা বলা যায়, আমাদের দেশের মানুষ তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে আগামীতে দেশে কী ধরনের সংস্কার দরকার।

লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা