মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়নে গেজেট প্রকাশ সময়ের দাবি

কোনো কালক্ষেপণ নয়, স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা এখন কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—এটি দেশের শিক্ষার ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য নেয়া একটি নৈতিক ও যৌক্তিক পদক্ষেপ।

জাকির হোসাইন

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) – নামের ঐক্যের আড়ালে এখানে যে তীব্র বৈষম্য বিদ্যমান, তা দেশের শিক্ষার মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব, সুযোগ ও প্রাপ্যতার নিরিখে কলেজ শিক্ষকদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা। এটি কেবল ব্যক্তিগত অধিকারের লঙ্ঘন নয়, বরং দেশের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নেও প্রকট বাধা। এমন পরিস্থিতিতে, অনুমোদিত স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দ্রুত বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি, জাতীয় শিক্ষার পূর্বশর্ত।

উচ্চপদে বৈষম্য: কলেজ শিক্ষকদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ:

মাউশির কাঠামোগত দুর্বলতা এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণই এই প্রশাসনিক বৈষম্যের মূল কারণ। যেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কলেজের তুলনায় অন্তত দশগুণ বেশি, সেখানে অধিদপ্তরের উচ্চ পদগুলো প্রায় সবই কলেজ শিক্ষকদের দখলে। উচ্চ গ্রেডের অধিকারী হওয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রতি তাদের আচরণে প্রায়শই ঔদাসীন্য ও অবমূল্যায়ন ফুটে ওঠে। মাধ্যমিক শিক্ষকরা পদোন্নতির সীমিত ও জটিল পদসোপানে আটকে থাকায় তাদের সমস্যা ও চাহিদা উচ্চপদস্থদের অবহেলা ও অনিয়মের শিকার।

অবৈধ অর্থের উৎস ও ষড়যন্ত্রের জাল:

মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার অনুমোদন, এমপিওভুক্তি, শিক্ষক নিয়োগ, বদলি এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণের খাত মাউশির ভেতরে একশ্রেণির কলেজ শিক্ষক-কর্মকর্তার জন্য 'অবৈধ ইনকামের কারখানা' হিসেবে কাজ করছে বলে অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। এই অবৈধ অর্থ উপার্জনের পথ টিকিয়ে রাখতেই তারা স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করছেন। তাদের 'সমন্বয়হীনতার' অজুহাত কেবলই নিজেদের অনৈতিক সুবিধা হারানোর ভয়।

এই চক্র মাধ্যমিক শিক্ষকদের ন্যায্য পদোন্নতি আটকে দেয়া, তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মাধ্যমিক শিক্ষার অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকদের প্রশাসনের কেন্দ্রে আসা ঠেকাতে এই চক্রের তৎপরতা দেশের শিক্ষার ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে।

স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের যৌক্তিকতা ও উপকারিতা:

মাধ্যমিক শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে এই শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে অবশেষে পৃথক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার। সর্বশেষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আলাদা অধিদপ্তর করার অনুমোদন দিলেও, কার্যত এর দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের ৪ দফা দাবিতে কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জন এই ক্ষোভেরই যৌক্তিক বহিঃপ্রকাশ। মাধ্যমিক শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের অবহেলা দূর করে, শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত আমলাদের আধিপত্য থেকে মাধ্যমিক প্রশাসনকে মুক্ত করতে স্বতন্ত্র অধিদপ্তর অপরিহার্য:

দক্ষ ও কার্যকর প্রশাসন: একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর মাধ্যমিক স্তরের সুনির্দিষ্ট সমস্যা ও প্রয়োজনগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য নিবেদিত প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হবে, যা কেবল মাধ্যমিকের অভিজ্ঞ শিক্ষকরাই পরিচালনা করবেন।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুযোগ বৃদ্ধি: সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরা তাদের নিজস্ব পদসোপানে সর্বোচ্চ স্তরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। চার স্তরীয় পদসোপান বাস্তবায়িত হলে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান হবে, চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে।

দুর্নীতি হ্রাস: প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং মাধ্যমিক শিক্ষার দায়িত্ব মাধ্যমিক শিক্ষকদের হাতে ন্যস্ত হলে অবৈধ আর্থিক লেনদেন ও ঘুষ বাণিজ্যের মহোৎসব অনেকাংশে হ্রাস পেতে পারে।

শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন: মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেলে এবং তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলে তারা আরও মনোযোগ দিয়ে শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করতে পারবেন। ফলে জাতির ভিত্তিস্তর এই মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নত হবে।

সরকারের প্রতি জরুরি আহ্বান:

শিক্ষকদের হুমকি-ধমকি দিয়ে তাদের আন্দোলন দমিয়ে রাখার চেষ্টা না করে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষাবিভাগে কর্মরত দায়িত্বশীল আমলাদের অবিলম্বে তাদের দায়িত্বহীনতার অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। কলেজ শিক্ষকদের যেকোনো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত প্রতিহত করে, অনুমোদিত স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দ্রুত গেজেট প্রকাশ করা এখন নৈতিক ও বাস্তবসম্মত দায়িত্ব।

দেশের শিক্ষার বিশাল ও ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে আনা অপরিহার্য। এটি কেবল শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে না, বরং জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। আর কোনো কালক্ষেপণ নয়, স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা এখন কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—এটি দেশের শিক্ষার ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য নেয়া একটি নৈতিক ও যৌক্তিক পদক্ষেপ।

লেখক: সাংবাদিক