অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক দল গঠন

তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল যাদের সাথে আদর্শগত ও কর্মসূচিগত মিল রয়েছে তাদের মধ্যে ঐক্য করে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে জাতি উপকৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ঘোষণা দিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দলটির আত্মপ্রকাশ। নতুন এই দল নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ লক্ষণীয় মাত্রায় দেখা যাচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা গত সেপ্টেম্বরে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রথমে জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে প্রতিটি উপজেলা-থানায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে পথচলা শুরু করে। দেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম ছাত্রদের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্বের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সাহসী পদক্ষেপে অন্য অনেক পেশাজীবী রাজনৈতিক দল গঠনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। যার প্রমাণ মেলে অতিসম্প্রতি আইনজীবী এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সাবেক আমলাদের নেতৃত্বে পৃথক দু’টি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশে। গত ১৩ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আইনজীবীদের নেতৃত্বে ‘জনতার বাংলাদেশ পার্টি’ নামে নতুন একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন অ্যাডভোকেট সফিকুল ইসলাম সবুজ খান আর মহাসচিব হয়েছেন অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে পার্টির উপদেষ্টা মুফতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের তারুণ্য ধারণ করে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, একাত্তরের চেতনা অনুসরণ করে, ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে একঝাঁক তরুণ আইনজীবী ও ছাত্র-জনতা এবং অন্যান্য পেশাজীবীর উদ্যোগে এ নতুন রাজনৈতিক দল ‘জনতার বাংলাদেশ পার্টি’ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। এক সপ্তাহ ব্যবধানে ২০ মার্চ রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আমলাদের নিয়ে ‘জনতার দল’ নামে আরো একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। নবগঠিত দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শামীম কামালকে। ‘ইনসাফ জিন্দাবাদ’ সেøাগানে যাত্রা শুরু করা দলটির চেয়ারম্যান বলেন, আমরা শুধু সৎ, সাহসী, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক ও নিষ্ঠাবান মানুষ নিয়ে এগোতে চাই। এতে যদি ১০ জন লোক থাকে তাই নিয়ে এগোতে চাই।

গত ৪ জানুয়ারি রাজধানীর কাওরান বাজারে ইডিবি ট্রেড সেন্টারে সাম্য, ন্যায়বিচার, অহিংস, মানবতা, চির উন্নত সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সেøাগান নিয়ে ‘দেশ জনতা পার্টি’ নামে একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। মো: নূর হাকিমকে চেয়ারম্যান ও ইদ্রিস আলী নান্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যমুক্ত, কার্বন নিঃসরণ শূন্য, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত, অহিংস, অসাম্প্রদায়িক নিরাপদ ও বাসযোগ্য মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।

পত্র-পত্রিকার খবব অনুযায়ী, গত ছয় মাসে কম করে হলেও ১৫টি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার পতনের ১৯ দিনের মাথায় ২৩ আগস্ট প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ-এনপিবি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে দলটির আত্মপ্রকাশ। এর ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে ১৬ দিন পর গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে এস এম শাহাদাতের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। ২৩ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি-বিপিপির’। ১৫ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি-বিআরপি’, ২৮ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি। ৩০ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি-বিজিপি’ নামে আরেকটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

গত ২৮ জানুয়ারি মেজর জেনারেল (অব:) মো: এহতেশাম উল হকের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘নতুন সমাজ সমৃদ্ধ দেশ, হোক জনগণের বাংলাদেশ’ সেøাগান নিয়ে ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ নামে আরো একটি দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে।

নবগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, আমজনতার দল ও বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, সার্বভৌমত্ব আন্দোলন ও জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। যদিও নতুন গঠিত বেশির ভাগ দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেশবাসীর কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তাছাড়া কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিলেও জোরালোভাবে দলীয় ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে এমন কোনো লক্ষণ খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ করা বেশির ভাগ দলের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশবাসী এখনো তেমন ওয়াকিবহাল হতে পারেননি।

আমরা নতুন দলের আবির্ভাবকে স্বাগত জানাই, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নতুন গঠিত এক-দুটি বাদে এসব রাজনৈতিক দল সামগ্রিকভাবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সামাজিক মূল্যবোধ ও ন্যায্যতা, বাকস্বাধীনতা সর্বোপরি অর্থনৈতিক মুক্তির দিশারী হিসেবে কতটা ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে তা সময়ই বলবে।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বহু দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেকে কথার ছলে বলে থাকেন ওয়ান ম্যান ওয়ান পার্টি। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডান-বাম, ইসলামী ঘরানার মিলিয়ে দেশে মোট নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪৮টি। অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত কঠিন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ৭০টি দল ও সংগঠন। এর মধ্যে ২৯টি দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আশ্রয় নেয়। ৩২টি দল জাতীয় পার্টির সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বিএনপির সঙ্গে ছিল পাঁচটি দল।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে পাঁচদলীয় জোট এ তিন জোটসহ অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন এরশাদ সরকার কৌশল করে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে নামসর্বস্ব দলগুলোর সমন্বয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) গঠন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ জোটের কার্যক্রম দেশব্যাপী এতটা হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল যে, দেশবাসী একে গৃহপালিত বিরোধী দল বলতেন।

বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যাধিক্য এত যে, দেশের মানুষ হাতেগোনা কয়েকটি দলের নাম ছাড়া অপরাপর দলের নাম সম্পর্কে অবহিত কি না এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া দেশের এতগুলা রাজনৈতিক দলের ভূমিকাইবা কী?

সাধারণভাবে যা দেখা গেছে, দেশে যতবার অগণতান্ত্রিক শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে এবং ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে ততবার ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের কদর বেড়েছে। রাজনৈতিক সঙ্কট কাজে লাগিয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এসব ছোট দলগুলো। যদিও এর ব্যতিক্রম আছে। কয়েকটি দল নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার আদায়ে রাজপথে লড়াই করছে।

কাজেই দু-একটি বাদে নতুন নতুন দলের আবির্ভাবে দেশবাসী খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন কি? যদিও ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং এর দোসর, চেলারা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে পলায়নের পর যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সবার জানা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন, অগ্রগতি নির্ভর করে। একই সাথে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে জনকল্যাণ ও রাষ্ট্রের সুবিধা জনগণ ভোগ করেন। ফলে রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ হচ্ছে জনগণের আকাক্সক্ষা ও চেতনা ধারণ করা। বাস্তবে আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, ঘোষণাপত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শত্রু-মিত্র নির্ধারণ ইত্যাদি অনেক বিষয়ে দেশের মানুষ অবগত নন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতি ও নেতৃত্ব সম্পর্কে যা কিছু উল্লেখ থাকুক না কেন, সাধারণ নাগরিক রাজনীতি বলতে বোঝেন প্রত্যেক দল নিজেদের আদর্শ, উদ্দেশ্য লক্ষ্য এবং সরকার গঠন করতে পারলে দেশের মানুষের কল্যাণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে তা মিছিল-সমাবেশ, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তুলে ধরবে। একই সাথে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে জনগণের কাছে প্রদত্ত ওয়াদা পূরণ করবে এমন বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা। কিন্তু আমাদের দেশে সারা বছর জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে না থাকলেও নির্বাচনের সময় কিছু রাজনৈতিক দল বড় দলগুলোর সাথে জোট গঠনে তৎপর হয়ে ওঠে। আর বড় দলগুলোও তাদের প্রতি বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের আস্থা আছে এমন বার্তা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে জোট গঠনে সক্রিয় হয়।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক শক্তির ভিন্নমত ও পথকে অবশ্যই স্বাগত জানাই আমরা। তবে দল হিসেবে শুধু সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা-বিবৃতি এবং টকশোতে আলোচনার মাধ্যমে কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকবে, সত্যিকারের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জাতির সামনে নিজেদের মেলে ধরতে পারবে না; তা কাম্য হতে পারে না। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল যাদের সাথে আদর্শগত ও কর্মসূচিগত মিল রয়েছে তাদের মধ্যে ঐক্য করে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে জাতি উপকৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট