আফ্রিকার দেশ সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। গৃহযুদ্ধ দেশটির পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ায় এসব মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দেশটির দুই কোটি ১০ লাখ লোক তীব্র খাদ্য সঙ্কটে ভুগছেন। জাতিসঙ্ঘের মানবিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে- পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে।
দারফুর অঞ্চলের আল বাশার, দক্ষিণ কর্ডোফানের কাদুগলি ও পূর্ব দারফুরের গ্রামগুলোতে সঙ্ঘাত ও খাদ্যসঙ্কট একযোগে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে, এসব এলাকায় ইতোমধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। শুধু দুর্ভিক্ষ নয়, আরো মারাত্মক খবর হলো- সেখানে নির্বিচারে গণহত্যা চলছে। একটি হাসপাতালে প্রায় ৫০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রোগী ও তাদের পরিবারের সদস্য রয়েছেন। গাজার গণহত্যায় সারা বিশ্বের মানুষ যখন হতবাক এবং নিস্তব্ধত। হায়েনারা যখন ৭০ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যার পর প্রশ্নবিদ্ধ যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে পৈশাচিক গণহত্যায় কিছুটা বিরতি পালন করেছে- তখন সুদানে যুদ্ধের মোড়কে আরেকটি গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু কেন? একবিংশ শতাব্দীর চরম উৎকর্ষতার এ যুগে এসেও কি বর্বরতা ও নৃশংসতার অবসান ঘটবে না?
১৯৮৯ সালে সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের ক্ষমতায় আসা ওমর আল বাশারকে পদ থেকে সরাতে ২০১৯ সালে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। তার ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের পতন ঘটায়। দেশের ক্ষমতায় আসে সেনাবাহিনী। কিন্তু সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষেভ অব্যাহত রাখলে পরবর্তীতে বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিলিত হয়ে একটি অস্বস্তিকর জোট সরকার গঠিত হয়েছিল।
ওমর আল বশির ১৯৮৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকলেও তাকে অন্যান্য অপরাধের সাথে ২০০৩ সালের দারফুর গণহত্যায় বিচারের মুখোমুখি করায় গণবিক্ষোভে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে হয়। বশির ক্ষমতা ছাড়লেও তার গড়ে তোলা আরএসএফ বাহিনীর সাথে অন্য গোষ্ঠীর সঙ্ঘাত শুরু হয়। মূলত, বশিরকে রক্ষা ও দারফুরকে তার হয়ে লড়াই করতে জানজাউইদ যোদ্ধাদের নিয়ে আরএসএফ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনী ওই অঞ্চলের অনারব বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। একজন ব্যতিক্রমী যুদ্ধবাজ মোহাম্মদ হামাদান দানালোর নেতৃত্বে এ বাহিনী পরিচালিত হয়। তারা প্রাথমিকভাবে সুদানি সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে। ২০২১ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থান বশির-পরবর্তী আধাসামরিক ব্যবস্থা উৎখাত করে। যেটি এক ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হতে করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে আরএসএফ ও এসএএফএর মধ্যে সংঘর্ষের পর সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। খার্তুম ছিল আরএসএফের রোষের লক্ষ্যবস্তু। তারপর থেকে উভয়পক্ষ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে যে যুদ্ধ শুরু হয়- সেটি সেনাবাহিনীর সাথে কোনো ছোটখাটো বিদ্রোহী বাহিনীর সংঘর্ষ ছিল না। এটি ছিল দু’টি পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধ। কারণ দু’পক্ষের হাতে অস্ত্রভাণ্ডার, হাজার হাজার সেনা, অর্থের উৎস, অর্থাৎ- সব কিছু ছিল।
সঙ্ঘাত শুরুর পর থেকে সেখানে কয়েক কোটি মানুষ তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছেন। প্রায় দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সুদানের দারফুর অঞ্চলের আল ফাশের শহর মিলিশিয়া বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) অবরোধ করে রাখার পর স¤প্রতি এ বাহিনী সেখানে ঢুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সুদানের উত্তর কর্ডোফান অঞ্চলের রাজধানী আল ও বেইদ শহরে একটি দাফন অনুষ্ঠানে ভয়াবহ হামলায় ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে। চলমান গৃহযুদ্ধের মধ্যে বেসামরিক জনগণের ওপর সহিংসতার মাত্রা কত বেড়েছে- এটি তার প্রমাণ। আরএসএফ কত নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করেছে, তা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে ও ভ‚মিতে জমে থাকা রক্ত দেখে বুঝা যায়। আল ফাশের পতনের পর প্রথম কয়েক ঘণ্টার গণহত্যার তীব্রতা রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এ দুই পক্ষ আগে একই সাথে সরকারের অংশীদার ছিল। কিন্তু এখন একে অপরকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
দারফুর ও আলকাশের অঞ্চলে বর্তমান যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চলছে তার পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বড় ভ‚মিকা রাখছে বলে বলা হচ্ছে। তারা যুক্তরাজ্য ও চীনের মতো উৎস থেকে অস্ত্র সরবরাহ করে, পাশাপাশি কলম্বিয়া থেকে ভাড়াটে সৈন্যও সরবরাহ করে। এ সম্পর্ক সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন আরএসএফ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে সৌদি আরব ও আমিরাতের পক্ষে সৈন্য পাঠিয়েছিল।
আমিরাতের এখানে কী স্বার্থ? জানা গেছে, সুদানের খনি থেকে স্বর্ণের সরবরাহ লাভ করা, উর্বর খাদ্য উৎপাদনকারী ভ‚মিতে প্রবেশাধিকার এবং লোহিত সাগরের বন্দরগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করা। এগুলো থেকে ইতোমধ্যে তারা লাভবান হচ্ছে, অর্থাৎ- বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পথ সুগম করেছে। আমিরাত আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইসরাইলের সহযোগিতায় ইয়েমেনি উপক‚লের কাছের বন্দরগুলো এবং দ্বীপপুঞ্জ ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও সুদানে তাদের প্রক্সিদের সহায়তা করতে লিবিয়া ও সোমালিয়ায় নিজেদের ক্লায়েন্টদের ব্যবহার করছে। অপরদিকে, এসএএফ আমিরাতের আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›দ্বী সৌদি, কাতার ও মিসরের সমর্থন পাচ্ছে বলে বলা হচ্ছে।
তথাকথিত আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় বা জাতিসঙ্ঘ এ গণহত্যা বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন? এ গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যায় কারা পৃষ্ঠপোষকতা করছে- সে ব্যাপারে যে তথ্য জানা যাচ্ছে, সেই পৃষ্ঠপোষকদের থামিয়ে দিলে তো গণহত্যা বন্ধ করা সম্ভব।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, ‘আমাদের খ্রিষ্টানদের’ ওপর হামলকারী সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করতে মার্কিন বাহিনী নাইজেরিয়ায় প্রবেশ করতে পারে। আফ্রিকার অন্যান্য অনেক দেশের মতো নাইজেরিয়া ও বোকো হারামের মতো উগ্রবাদীদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। তবে সেখানে কেবল খ্রিষ্টানরাই সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে না। তা ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়তো জেনেও না জানার ভান করছেন, আফ্রিকাজুড়ে কয়েক দশক ধরে আল কায়েদার সহযোগী ও তাদের শাখা-প্রশাখার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনে মার্কিন সামরিক বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট ধর্মের ওপর জোর দেয়া ট্রাম্পের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার প্রমাণ অথবা তার মিথ্যাচারকে প্রতিফলিত করে। কারণ, তিনি গাজার খ্রিষ্টানদের প্রাণহানি বা ঝুঁকির মুখে পড়া নিয়ে কখনো কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। নাইজেরিয়া নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও, এটি এখন আফ্রিকার সবচেয়ে উদ্বেগজনক সমস্যাগ্রস্ত অঞ্চল নয়। সুদান হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাতে জর্জরিত অঞ্চল। দেশটি ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ হতে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের সঙ্ঘাত ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে।
সুদানের যুদ্ধকে অনেকে ভুলে যাওয়া যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। এটি বিশ্বশক্তিগুলোর চুপ থাকা ও অবহেলার ফসল। তবে কারোর এ বিভ্রান্তিতে থাকা উচিত নয়, সম্ভবত সবচেয়ে নিকৃষ্টতম খলনায়কের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন প্রত্যাহার করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে রাজি করানো সুদানের জন্য একটি প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দেশটির বাইরে আফ্রিকার জন্য একবিংশ শতাব্দীর লড়াই দ্রুত গতিতে চলছে। সেই সাথে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক বা নব্য-ঔপনিবেশিক শক্তি বা উপসাগরীয় এবং তার বাইরের নবীন আধিপত্যবাদীরা কেউ শিগগির পিছু হটতে চাচ্ছে না। গাজা এবং তার অনেক দূরে ভুক্তভোগীদের তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বর্তমান এবং অতীত থেকে ভবিষ্যৎ আলাদা হতে পারে কি না তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।


