বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) প্রায়ই বাংলাদেশীদের হত্যা করে। বাংলাদেশ বহুবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানালেও তা বন্ধ হয়নি। ভারত বিভিন্ন সময়ে হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কার্যকর করেনি। ফলে নিয়মিতভাবেই সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা চলছে। সীমান্তে নিরাপত্তা রক্ষায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু বিএসএফের হাতে বাংলাদেশীদের হত্যার ঘটনা বন্ধে তারা বরাবরই ব্যর্থ।
বিএসএফ বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবেই সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করে চলেছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৫-২৪ পর্যন্ত ১০ বছরে বিএসএফ ৩০৫ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। ২০১৫ সালে ৪৩ জন, ২০১৬ সালে ২৮ জন, ২০১৭ সালে ৩০ জন, ২০১৮ সালে ১৫ জন, ২০১৯ সালে ৪২ জন, ২০২০ সালে ৫১ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন, ২০২৩ সালে ৩০ জন এবং ২০২৪ সালে ২৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। তারা ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত আরো পাঁচ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এসব হত্যার কোনো বিচার হয়নি। বিএসএফ জওয়ানদের গুলিতেই এসব নিরীহ বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত রেডক্লিফ লাইন নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় এই বর্ডার লাইন নির্ধারিত হয়। ভারত-পাকিস্তান বর্ডার কমিশনের চেয়ারম্যান ব্রিটিশ আইনবিদ স্যার সিরিল রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট এটি নির্ধারণ করেন। আজকের বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সাথে ভারতের নির্ধারিত সীমানাই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্ত। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা রয়েছে এবং এটি পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্ত লাইন। ভারতের পাঁচটি রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। আসামের সাথে ২৬২ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সাথে ৮৫৬ কিলোমিটার, মিজোরামের সাথে ৩১৮ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সাথে ৪৪৩ কিলোমিটার ও পশ্চিমবঙ্গের সাথে দুই হাজার ২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যেই প্রায় তিন হাজার ১৮০ কিলোমিটার বেড়া নির্মাণ স¤পন্ন করেছে। বাকি ৯১৬ কিলোমিটার সীমান্তে ঘন বনভূমি, উঁচু পর্বতমালা, নদীপথ এবং জলাভূমি থাকায় বেড়া নির্মাণ করতে পারেনি। সীমান্তে হত্যা এবং বেড়া নির্মাণ নিশ্চয়ই বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়।
এছাড়া তাদের হামলায় বিভিন্ন সময়ে বহু বাংলাদেশী আহত হয়েছে এবং এদের কেউ কেউ পঙ্গু হয়েছে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানী খাতুন নামে ১৫ বছর বয়সী বাংলাদেশী মেয়েকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। পরদিনই তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তার লাশ দীর্ঘ সময় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছিল। এই ছবি সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ফেলানী হত্যায় জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষসহ অন্যদের ভারতের আদালত খালাস দেয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে আপিল করা হলেও এখনো সেই বিচার সম্পন্ন হয়নি।
বিএসএফ ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী স্বর্ণা দাস এবং ৯ সেপ্টেম্বর ১৫ বছরের জয়ন্ত কুমার সিংহকে হত্যা করে। স্বর্ণা দাস তার মায়ের সাথে ভারতের ত্রিপুরায় বসবাসরত ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যাচ্ছিল। এভাবে ভারত সীমান্তে নিরাপত্তার নামে নিরপরাধ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করে চলেছে।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক নীতিমালা রয়েছে। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স¤পাদিত এরকম দু’টি চুক্তি হচ্ছে জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইন্স ফর বর্ডার অথরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ এবং দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, ২০১১। জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইন্স ফর বর্ডার অথরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ অনুসারেÑ এক দেশের নাগরিক যদি বেআইনিভাবে অন্য দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে বা কোনো অপরাধে জড়ায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী আত্মরক্ষায় যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে, তবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করাটাই বাঞ্ছনীয়। অথচ ভারত এসব চুক্তি মানছে না। সীমান্তে কোনো বাংলাদেশী আইন ভঙ্গ করে অপরাধ করলে তাকে আটক করে আইনের আওতায় আনা ও বিচার করে শাস্তি দেয়া যায়। কিন্তু বিএসএফ সেই পথ অনুসরণ করে না। তারা সবসময় এবং কিছু হলেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে এবং বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করছে। সীমান্ত সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে অনেক বৈঠক হয়েছে এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। এসব বৈঠকের প্রত্যেকটিতেই বিএসএফ, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বিএসএফ কখনোই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।
আমরা সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা চিরতরে বন্ধের দাবি জানাই। প্রয়োজনে এই ইস্যু জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই বাস্তবতা ভারতকে মানতে হবে। বাংলাদেশ সবসময় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে সুস¤পর্ক চায়। প্রতি বছর বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশী চিকিৎসা, ব্যবসায় ও পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে ভারতে যায়। প্রচুর ভারতীয়ও বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকার বহু মানুষ নিজেদের মধ্যে বিয়ে শাদির মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তুলেছে। দেশ দু’টির মধ্যে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় রয়েছে। সীমান্তে ব্যবসায়-বাণিজ্য স¤পাদনে একাধিক নদীবন্দর, স্থলবন্দর এবং কাস্টম হাউজ রয়েছে। অনেকগুলো সীমান্ত হাট রয়েছে। দেশ দু’টির মধ্যে বাস ও ট্রেন চলাচল বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত এবং অভিন্ন নদী রয়েছে। কিন্তু ভারত সবসময় সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা এবং বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীর ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করে চলেছে। কিছু হলেই ভারত বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদান এবং বাংলাদেশে আলু, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ভারত নিরাপদ আশ্রয় দেয়। ফলে বাংলাদেশ সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এসবের অবসান চাই। তার জন্য ভারতকে সীমান্ত হত্যা চিরতরে বন্ধ করতে হবে, অভিন্ন নদীর ন্যায্য পানি বাংলাদেশকে দিতে হবে এবং পারস্পরিক স্বার্থে বন্ধত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে। বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতকেই এসব বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী



