আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংক একীভূতকরণ

একীভূত অথবা অধিগ্রহণের নির্দেশনায় ও এর বাস্তবায়নে দু’টি পক্ষ চিন্তিত হতে পারে। প্রথমত, আমানতকারী এবং দ্বিতীয়ত, একীভূতকৃত ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী। আমানতকারীদের ভয় থাকবে জমাকৃত আমানতের সুরক্ষা। তবে সে দায় একীভূত নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে পারে এবং উভয় শ্রেণীকে আস্থায় আনা যেতে পারে।

পতিত স্বৈরাচারী সরকার ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থার যে ভয়াবহ ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে তা উত্তরণে ও এ খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি জানিয়েছেন, এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করে একটি নতুন কাঠামোর আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলো নিয়ে প্রথম ধাপে কাজ শুরুর পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।

রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি ২০১৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ২৩ হাজার কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৯৮ শতাংশ এখন খেলাপি। এ ছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৯৬ শতাংশ এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৯৫ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে সোসাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও এক্সিম ব্যাংক, তবে এগুলোও ঝুঁকিমুক্ত নয়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। গত মার্চের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ- তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। পতিত সরকারের আমলে ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও কৃত্রিম তথ্যের বিপরীতে প্রকৃত সব তথ্য বের হয়ে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, আর্থিক খাতের এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণ কোনো নতুন ধারণা নয়; বরং দেশে ও বিদেশে সফল একীভূতকরণের অনেক উদাহরণ রয়েছে। বৃহৎ ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাংক বড় ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাংকের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। ১৯২৮-৩৩ এর মহামন্দা, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্যোগ, ১৯৯৯ সালের ‘দ্য গ্রাম-লিচ-ব্লিলি অ্যাক্ট’ ইত্যাদি কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের সংখ্যা কমে যায়। কিন্তু ১৯৯৯ সালের আইনের কারণে ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের পথ সুগম হয়। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে বিনিয়োগ ব্যাংকের একীভূত অথবা অধিগ্রহণ হয় আবার উল্টোটাও ঘটে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০১৭ সালের আগে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ছিল ১৭টি। এগুলো পরে ১০টি ব্যাংকে একীভূত হয়। একীভূত অথবা অধিগ্রহণের নির্দেশনায় ও এর বাস্তবায়নে দু’টি পক্ষ চিন্তিত হতে পারে। প্রথমত, আমানতকারী এবং দ্বিতীয়ত, একীভূতকৃত ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী। আমানতকারীদের ভয় থাকবে জমাকৃত আমানতের সুরক্ষা। তবে সে দায় একীভূত নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে পারে এবং উভয় শ্রেণীকে আস্থায় আনা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত যে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে- সোসাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

একীভূতকরণের প্রথম ধাপ শেষে ব্যাংকগুলো সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ব্যাংকগুলোর এমডিদের চুক্তি বাতিল হবে। আর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের বাছাই করা সদস্যসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধির সমন্বয়ে পর্ষদ গঠন করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বিক দিকনির্দেশনায় ব্যাংকগুলো পরিচালিত হবে।

ইতঃপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জানুয়ারিতে এসব ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের (একিউআর) জন্য দু’টি আন্তর্জাতিক অডিটর নিয়োগ দেয়। এ দিকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, একীভূতকরণের ফলে কোনো কর্মী তাদের চাকরি হারাবেন না। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একীভূতকরণ একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে, তবে এটি সফল হওয়ার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন। যেমন-

১. মূলধনের ঘাটতি পূরণ : একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত মূলধন বাড়ানো যায়, যা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বাড়ায়।

২. সুনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ : শক্তিশালী ব্যাংকের নীতিমালা প্রয়োগ করে ঋণের মান নিয়ন্ত্রণ ও খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব।

৩. সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও করপোরেট গভর্ন্যান্স জোরদার : একীভূতকরণের পরে নতুন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা বোর্ডে দক্ষ ও স্বচ্ছ পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে।

৪. অডিট ও রেগুলেশন কঠোর করা : একীভূত ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারি রাখতে হবে এবং আর্থিক প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে।

৫. প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি : এ জন্য অপারেশনাল দক্ষতা প্রয়োজন। একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর অপারেশনাল ব্যয় কমে (যেমন- শাখা, কর্মচারী ও প্রযুক্তির সমন্বয়), যা ব্যাংককে লাভজনক করে তুলতে পারে।

৬. প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ : শক্তিশালী ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং ও ফিনটেক সমাধান দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে, যা গ্রাহকসেবা উন্নত করে।

৭. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ও নীতিগত সমর্থন : বাংলাদেশ ব্যাংককে একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে প্রণোদনা (যেমন- কর ছাড়, লাইসেন্সিং সহজীকরণ) দিতে হবে। পাশাপাশি তদারকি জোরদার করতে হবে। নতুন ব্যাংকগুলোর সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা, রিজার্ভ এবং ঋণনীতি কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে।

৮. সরকারি হস্তক্ষেপ ও আইনি সংস্কার : সরকারি হস্তক্ষেপ ও আইনি সংস্কার দরকার হবে। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। দেউলিয়া আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে জবাবদিহি বাড়াতে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

৯. গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো : একীভূতকরণের লক্ষ্য ও সুবিধাগুলো গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারদের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিআইসিসির (ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স) ভূমিকা শক্তিশালী করতে হবে। ব্যাংক একীভূতকরণ শুধু সংখ্যা কমালে শৃঙ্খলা ফিরবে না; বরং এটি একটি বৃহত্তর সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হওয়া উচিত। এ জন্য সুশাসন, প্রযুক্তির ব্যবহার, রেগুলেটরি কাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা একসাথে প্রয়োজন। সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে, এটি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে আরো টেকসই ও বিশ্বস্ত করে তুলতে পারে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
[email protected]