শিক্ষায় অচলাবস্থা

সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের কি আন্দোলনের পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে?

জাকিরুল ইসলাম
জাকিরুল ইসলাম |ছবি : নয়া দিগন্ত

জাকিরুল ইসলাম
গত দু’দিন ধরে দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, তা কেবল বার্ষিক পরীক্ষা বাতিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের শিক্ষাপ্রশাসনের গভীরে জমে থাকা এক দীর্ঘদিনের উদাসীনতা ও বৈষম্যের জীর্ণ চিত্র তুলে ধরেছে। ‘এন্ট্রি পদ ৯ম গ্রেডসহ চার দফা’ দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরা যখন পূর্ণ কর্মবিরতিতে, তখন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষকরা বলছেন, তারা কর্তৃপক্ষের কাছে যৌক্তিক আন্দোলনের যুক্তি তুলে ধরেছিলেন, কিন্তু উল্টো তাদেরকে আন্দোলন করেই দাবি আদায় করতে বলা হয়েছে—এ কেমন দায়িত্বশীলতা?

শিক্ষা প্রশাসনের এই অসংবেদনশীলতা এবং শিক্ষকদের দাবি পূরণে ব্যর্থতাই আজকের অচলাবস্থার মূল কারণ। শিক্ষকদের এই যৌক্তিক আন্দোলনকে আমলে না নিয়ে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে শিক্ষা প্রশাসন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) স্বাক্ষরিত পরিপত্রে পরীক্ষা গ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। অথচ এই প্রশাসনই তাদের কলেজ-শিক্ষক সহকর্মীদের কর্মবিরতির ক্ষেত্রে নমনীয় ছিল—সেখানে কোনো শাস্তির হুঁশিয়ারি আসেনি; বরং দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

একই ছাদের নিচে দুই নিয়ম কেন?
শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড হলো শিক্ষক সমাজ। অথচ এই সমাজেই এখন স্পষ্ট বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষাপ্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে প্রায়শই শিক্ষা ক্যাডারের কলেজ শিক্ষকরাই আসীন থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই, যখন কলেজ শিক্ষকরা তাদের দাবিতে আন্দোলন করেন, তখন বাধা আসে না। কিন্তু তাদের অধীনস্থ মাধ্যমিক শিক্ষকদের চার দফা দাবি— যার মধ্যে রয়েছে সহকারী শিক্ষক পদটিকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করা, শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ-পদোন্নতি, বকেয়া টাইমস্কেল প্রদান এবং ইনক্রিমেন্ট সুবিধা বহাল রাখা— তা পূরণের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বছরের পর বছর ধরে আশ্বাস দিয়েও আল্টিমেটামের সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পরও দাবি আদায় না হওয়ায় শিক্ষকরা কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

এতে স্পষ্টতই শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রতি একধরনের ঔদাসীন্য ফুটে ওঠে। শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিকে দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁদে ফেলে দিয়ে যখন তাদের আন্দোলনের পথে ঠেলে দেয়া হয়, তখন বুঝতে হবে এই প্রশাসনের মানসিকতা কেবল সমস্যা সমাধান নয়; বরং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও নিপীড়নের দিকে ঝুঁকে আছে।

শিক্ষার্থী ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদাসীনতা
শিক্ষকদের এই ধর্মঘটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ডিসেম্বরের এই সময়ে যখন বার্ষিক পরীক্ষা ও এসএসসি নির্বাচনী পরীক্ষা চলছে, ঠিক তখনই এই পরীক্ষা বর্জন এবং খাতা মূল্যায়ন থেকে বিরত থাকার ঘোষণা শিক্ষা কার্যক্রমে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। জেলা প্রশাসকরা প্রধান শিক্ষকদের ডেকে পরীক্ষা নেয়ার চাপ দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সাধারণ শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে অনড় অবস্থানে থাকায় প্রধান শিক্ষকরা একা পরীক্ষা নিতে পারছেন না।

শিক্ষক নেতাদের আশ্বাসে হয়তো সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হতে পারে, কিন্তু একটি শিক্ষাবর্ষের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমন ভজঘট তৈরি হওয়াটা কখনোই কাম্য নয়। শিক্ষাপ্রশাসনের এই উদাসীনতা প্রমাণ করে যে তারা শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকারের চেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা এবং শিক্ষকদের ভয় দেখিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার কৌশলকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।

শিক্ষকদের আন্দোলন যৌক্তিক, তাদের দাবি ন্যায্য। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাসের পরও সুরাহা না পাওয়ায় তারা কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে, শাস্তি বা কঠোর ব্যবস্থার হুমকি না দিয়ে, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল অবিলম্বে শিক্ষক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসে দ্রুততম সময়ে এই অচলাবস্থা নিরসনের পথ খুঁজে বের করা।

শিক্ষকরা যদি সত্যিই আন্দোলনরত থাকেন এবং শিক্ষাপ্রশাসনের উদাসীনতা অব্যাহত থাকে, তবে তা কেবল শিক্ষাব্যবস্থারই ক্ষতি করবে না; বরং একটি জাতির ভবিষ্যতকেও অন্ধকারে ঠেলে দেবে। শিক্ষাকে পণবন্দি করে কোনো প্রশাসন চলতে পারে না। সময় এসেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। নইলে এই আন্দোলন এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভের জন্ম দেবে, যার ফল হবে সুদূরপ্রসারী এবং বেদনাদায়ক।

লেখক : শিক্ষক, কুষ্টিয়া জিলা স্কুল