১৬ মে এক অবহেলিত গুরুত্বপূর্ণ দিন

মুসলিম লীগের ওই ভূমিধস বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল জমিদারি উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি। মুসলিম লীগ তাদের ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং ১৯৫১ সালের ১৬ মে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করেছিল।

১৬ মে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। অথচ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো সচেতনতা নেই। তারা জানেই না যে, ১৯৫১ সালের ১৬ মে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং জমির ওপর সাধারণ মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়ার আগ পর্যন্ত জমির মালিক ছিল জমিদার আর সাধারণ মানুষ জমিদারকে খাজনা দেয়ার শর্তে জমিদারের মালিকানাধীন জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করতে পারত।

জমিদাররা যে শুধু ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ভূমির খাজনা আদায় করত, তা নয়; তারা নিজেরাও দরিদ্র প্রজাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স আরোপ করত। হিন্দু প্রজাদের চেয়ে মুসলমান প্রজারাই বেশি নিপীড়নের শিকার হতো। অনেক জমিদার দাড়ি রাখার ওপর, মুসলিম নাম রাখার ওপর, খতনা করার ওপর, মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ওপর, খানকা ও দরগার ওপর ট্যাক্স আরোপ করেছিলেন। কোরবানির সময়ও তারা গরু জবাই করতে দিতেন না। জমিদারের পেয়াদা প্রজাদের বাড়ি থেকে ফলফলাদি, পুকুরের মাছ, হাঁস-মুরগি এমনকি তরিতরকারিও বিনা পয়সায় জোর করে নিয়ে যেত। জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রজারা ছাতা মাথায় দিয়ে ও জুতা পায়ে দিয়ে হেঁটে যেতে পারত না। প্রজাদের সুন্দরী স্ত্রী ও মেয়েরা তাদের লোলুপ কামনার শিকার হতো। পূজা-পার্বণে মুসলমান প্রজাদের বেগার কামলা খাটতে হতো। এসব কারণে জমিদারদের সাথে প্রজাদের দ্বন্দ্ব বিরাজ থাকত। মীর নিসাব আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহদের বিদ্রোহ ছিল মূলত অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজাদের প্রকাশ্য বিদ্রোহ।

যারা জমি কেনাবেচার সাথে জড়িত তারা জানেন, জমি কেনাবেচার সময় সিএস খতিয়ান, এসএ খতিয়ান এসব ভালোভাবে দেখে নিতে হয়। সিএস খতিয়ান ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা হয়েছিল। ওই খতিয়ানে কোন জমি কোন জমিদারের কোন প্রজা ভোগ দখল করছেন তার একটা বিবরণ তৈরি করা হয়েছিল। সে কারণে খতিয়ানের পেছনের পৃষ্ঠায় জমিদারের নাম উল্লেখ থাকত। অন্য দিকে এসএ খতিয়ানে জমিদারের কোনো নাম নেই। কারণ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়ার পর পাকিস্তান আমলে এসএ খতিয়ান তৈরি করা হয়। এই খতিয়ানের মাধ্যমেই জমির ওপর সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়।

জমিদারি উচ্ছেদের ফলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ওই সময় পূর্ব বাংলার অর্থনীতি ছিল পুরোটাই কৃষিনির্ভর। জমির মালিকানা কৃষকদের হাতে চলে যাওয়ায় এক দিকে তাদের আর্থিক অবস্থার যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনি সামাজিক মর্যাদারও পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আগে জমিদারদের অনেকে ইচ্ছা করলেই জনপ্রতিনিধি হতে পারতেন; কিন্তু জমিদারি উচ্ছেদের পর ইচ্ছা করলেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার পথ সঙ্কুচিত হয়ে যায়।

বিস্ময়ের বিষয়, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন নিয়ে আমাদের সমাজজীবনে কোনো আলোচনা নেই। রাজনীতিকরা এটি নিয়ে কথা বলেন না। সংবাদমাধ্যমে এটি নিয়ে লেখালেখি হয় না। বুদ্ধিজীবীরাও বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন না। এ রকম একটি পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো সেটি নিঃসন্দেহে বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কারো কারো ধারণা, জমিদারি উচ্ছেদের প্রক্রিয়ার সাথে কংগ্রেস, আওয়ামী লীগ বা কমিউনিস্ট পার্টির কোনো সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে বিষয়টি খুব একটা আলোচনা হয় না।

মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মুসলিম লীগকে খাজা-গজাদের দল বলে সমালোচনা করা হলেও জমিদারি উচ্ছেদের কৃতিত্ব মুসলিম লীগেরই; অন্য কোনো দলের নয়। অবশ্য অনেকে মনে করেন, জমিদারি উচ্ছেদের ব্যাপারে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কথাটা অনেকাংশে সত্য, যদিও উচ্ছেদের আইনগত প্রক্রিয়ার সময় তিনি মুসলিম লীগের নেতৃত্বে না থাকার কারণে বড় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেননি।

অন্য দিকে কাস্তে-হাতুড়ির ছবিসংবলিত পতাকার বাহক ও প্রগতিশীলতার দাবিদার কমিউনিস্ট পার্টি জমিদারি উচ্ছেদের জন্য কোনো আন্দোলন করেনি। তাদের আন্দোলন ছিল, জমিদারি উচ্ছেদ না করে কৃষকের জন্য ফসলের ভাগ বৃদ্ধির আন্দোলন। তাদের সে আন্দোলনের নাম ছিল তেভাগা আন্দোলন; অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষককে দিতে হবে। তেভাগা আন্দোলনের বিষয়ে মুসলিম লীগের নেতা ও পূর্ব বাংলার সবচেয়ে বড় জমিদার খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্য ছিল, ওরা তেভাগার জন্য আন্দোলন করে আর আমরা কৃষকদের চার ভাগই দিতে চাই; অর্থাৎ জমির পুরো মালিকানাই দিতে চাই।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তার ইতিহাস ‘কথা কও’ বইয়ে লিখেছেন, মুসলিম লীগ প্রধান কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ বাংলার দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের ভুখা-নাঙ্গা শীর্ণ চেহারা দেখে বলেছিলেন, এদের এ অবস্থার অবসান ঘটাতে পাকিস্তান হাসিল করতেই হবে।

১৯৪৬ সালের বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৩টিতে জয়লাভ করে। মুসলিম লীগের ওই ভূমিধস বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল জমিদারি উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি। মুসলিম লীগ তাদের ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং ১৯৫১ সালের ১৬ মে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করেছিল।