আজকের নিবন্ধটি বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে তৈরি। ‘শেখ মুজিব ২২ পরিবার যেমন- আদমজি, বাওয়ানি, দাউদ, ইস্পাহানি প্রমুখের কাছ থেকে মোটাদাগের মাসিক চাঁদা নিয়ে দল চালাতেন, তার রাজনীতি ছিল চাঁদাবাজিনির্ভর। মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী মুজিবকে নিয়মিত চাঁদা দিতেন। তার চাকরির শুরুও ছিল পাকিস্তানের ইউসুফ হারুনের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। সে সময় তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। মুজিব মন্ত্রী হন পাকিস্তান আমলে। তখন ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে ৩২ নম্বর বাড়িটি দখল করে নেন, বলাকা সিনেমা হল এবং পুরান ঢাকায় ছিল তার অবৈধ স্থাপনা। মুজিব পাকিস্তানের অবৈধ টাকা দিয়ে শুধু পার্টি চালাননি, ছেলেদের বিয়ে দিয়েছেন এমনভাবে যা রাজপরিবারের জৌলুসকেও হার মানায়। গরিব দেশে যা ছিল বড়ই বেমানান। এককথায়, মুজিবের অর্থের জোগানদাতা ২২ পরিবার আর মুসলিম লীগ। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মিডিয়ার টকশোতে একাধিকবার এসব কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের সাথে এলিট বুর্জোয়া শ্রেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ছিল সুবিধাবাদী বামদের সখ্য।
দুই ছেলের বিয়ে রাজপরিবারের মতো হোটেল শেরাটনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বর্ণ আর হীরার মুকুট পরিহিত শেখ কামাল আর শেখ জামালের বিয়েতে গোটা জাতি হতবিহ্বল হয়ে যায়। বিয়েতে যে উপঢৌকন পেয়েছিল তা দিয়ে সেই সময়ের গোটা ‘মতিঝিল এলাকা’ কেনা যেত। দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ এবং সাপ্তাহিক হক কথা এবং অলি আহাদের ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সবিস্তারে প্রকাশিত হয় এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা। দেশে মুজিব সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। শেখ মুজিবের তিন বছর সাত মাস পাঁচ দিনের শাসনামল ছিল দুঃশাসনে ভরা। সেনাবাহিনীর বিকল্প রক্ষীবাহিনী গঠন করে সশস্ত্রবাহিনীর ভাবমর্যাদা একেবারেই তলানিতে নিয়ে গিয়েছিল।
রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী ও মুজিববাহিনী দ্বারা মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা হয়েছিল। ভিন্ন মতের লোকদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কথা বললেই সিরাজ সিকদার, জহির রায়হান, স্টুয়ার্ড মুজিব এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের মতো অনেকেই গুম ও খুন হয়েছিল। লুটপাট এবং ব্যাংক ডাকাতি সব কিছুতেই ছিল তাদের রাজত্ব।
দেশ স্বাধীনের পর ভারতীয় সেনারা তিন মাস বাংলাদেশে অবস্থান করেছিল। সে সময় তাদের মূল কাজ ছিল পাকিস্তানের ফেলে যাওয়া সমরাস্ত্র ও সরঞ্জাম লুট করা। বাংলাদেশের বড় বড় ইন্ডাস্ট্রির মূল্যবান যন্ত্রপাতি খুলে ট্রাক ও লরি ভর্তি করে ভারতে নিয়ে যায় তারা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একেবারে নীরব ছিল। বিভিন্ন কারণে দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কয়েক লাখ লোক না খেয়ে মারা যায়। দেশে ৪০ হাজার লঙ্গরখানা খোলা হয়। তখন সাংবাদিক ও কবি রফিক আজাদ কবিতায় লেখেন, ‘ভাত দে হারামজাদা না হলে মানচিত্র খাবো’। দেশে একদলীয় স্বৈরশাসন শক্তিশালী করার জন্য ৬৪ জেলায় মুজিব সমর্থিত ৬৪ জন গভর্নর নিয়োগ চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল।
পাকিস্তান ফেরত ৪৫ হাজার সেনাবাহিনী সদস্য দেশে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছিল। চট্টগ্রাম নোয়াপারা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান ফেরত বাঙালি সেনাসদস্যদের দেখতে গিয়েছিলাম ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত এক বন্ধুর সাথে। পাকিস্তান ফেরত বাঙালি সেনাসদস্যদের যেভাবে রাখা হয়েছে সব দিক থেকে তা ছিল অতি নিম্নমানের। তাদের সাথে কথা বললাম, পাকিস্তানে ৯ মাস কেমন ছিলেন। বলল ভালো ছিলাম। সেখানে কোনো অসুবিধা হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম এখন কেমন আছেন? বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন, বালতিতে ডাল, বদনায় খাবারের পানি। শোয়ার বালিশ নেই। সব কথা বলা যাবে না। স্বাধীন দেশে মনে হয় পরাধীন জীবন। একটি রুমে গাদাগাদি করে থাকা কষ্টকর, যা ভাবা যায় না। পাকিস্তান ফেরত বাঙালি সেনাসদস্যদের জীবনযাপন নিয়ে গণকণ্ঠে প্রচুর লেখালেখি হয়। সম্পাদক ছিলেন কবি আল মাহমুদ। মুজিব সৎমানুষ ছিলেন না, এটি তার দলের সিনিয়র নেতারা ও ঘনিষ্ঠজনরাও জানতেন এবং প্রকাশ্যে বলতেনও। মুজিব কেমন মানুষ ছিলেন প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমেদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, মুজিব ছিল বড় ডানপিটে স্বভাবের, মানুষের বাড়ির ডাব, আম, জাম, গাব, পেয়ারা এসব চুরি করে খেত। জেলেদের নৌকা কেড়ে নিত মাছ ধরার কথা বলে। পরে সে নৌকার আর হদিস পাওয়া যেত না। প্রধান শিক্ষককেও সে পিটিয়েছে। পড়াশোনায় সে কখনো ভালো ছাত্র ছিল না। এসব কথা জানা যায় গবেষকদের লেখায়, যা হক কথায় প্রকাশিত হতো। হক কথা এবং গণকণ্ঠে মুজিব চরিত্রের আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য বিশেষ করে দলেরই এক নেতার স্ত্রীর সাথে মুজিবের পরকীয়া প্রেমের ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়।
১৯৭২ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওই সময় পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রধান এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং কিছু দিনের জন্য পাকিস্তানের অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট, ফজলুল কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। মুক্তিযুদ্ধে তার বিতর্কিত ভূমিকা ছিল। এখানে একটি কথা না বললে নিজেকে ছোট করা হবে, অর্থাৎ বিবেকের কাছে দোষী সাব্যস্ত হবো। সেই সময়ের একটি ঘটনার কথা কখনো ভুলব না। ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশে ‘জেনারেল রাও ফরমান আলি’ বহু বন্দী মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিদিন লালদীঘি পুলিশ স্টেশন থেকে মুক্তি দেয়। এসব নিজের চোখে দেখা। আরেক দিনের ঘটনাÑ ফজলুল কাদের চৌধুরীর স্ত্রী স্থানীয় জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদীতে’ একটি পত্র লেখেন সম্পাদক বরাবর। সেই চিঠিটি হুবহু সম্পাদকীয় পাতায় ছাপানো হয়। বেগম ফজলুল কাদের চৌধুরী তার লেখায় তার স্বামীর জীবন নিয়ে শঙ্কিত বলে উল্লেখ করেন। ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত, তাই রাতে ইনসুলিন নিতে হয়। ১৯৭২ সালে একদিন জেলে দেখা করতে গিয়ে স্বামীর মুখ থেকে ভয়ঙ্কর সংবাদ পান বেগম ফজলুল কাদের চৌধুরী। চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে বলেছিলেন, আমি মৃত্যুর আশঙ্কা করছি, যেকোনো সময় আমার মৃত্যু হতে পারে। এখানে ডাক্তার এবং আমার তদারকি টিমের গতিবিধি আমার সন্দেহ হয়। তিনি বলেন, জেলেই আমার মৃত্যুর আশঙ্কা করছি। এসব কথা ফজলুল কাদের চৌধুরীর স্ত্রী তার লেখনীতে তুলে ধরেন। পুরো জেলখানা এবং বড় বড় সরকারি দফতর ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। যা হোক এর কিছু দিন পর হাসপাতালে ফজলুল কাদের চৌধুরী মারা যান। তার লাশ চৌধুরী সাহেবের চট্টগ্রামে সিরাজউদদৌলা রোডে অবস্থিত গুড হিল বাসভবনে নেয়া হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা লাশ দেখতে গিয়েছিলাম, কারণ তারই প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমরা। এই ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। আমরা তার জানাজা পড়ব এই নিয়তও ছিল। ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসভবনে গিয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য। গিজগিজ করছে মানুষ। ভিড় ঠেলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে লাশের পাশে এসে মানুষ বলাবলি করছে, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। দেখতে আসা সব মানুষ বলছে বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ছয় ফুটের ঊর্ধ্বে লম্বা দেহটি কালো হয়ে গেছে।
বিষাক্ত সাপের ছোবলে কারো মৃত্যু হলে যেমন চেহারা হয় সে রকম হয়েছিল ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুরো দেহ। একজন ধবধবে ফর্সা মানুষের দেহ এরকম কৃষ্ণকায় হয়ে গেল কেন? সবার মুখে একই কথা, আমাদের নেতাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে। উপরের নির্দেশে জেলে ডাক্তারের মাধ্যমে ইনসুলিন দেয়ার সময় তাকে হত্যা করা হয়। প্যারেড ময়দানে তার জানাজায় লোকে লোকারণ্য। এত মানুষ জানাজায় এর আগে কখনো আমি দেখিনি। বাসাবাড়ির ছাদ, ছোট টিলা এবং গাছেও দাঁড়িয়ে জানাজায় মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। অনেকেই বলেছে, পাঁচ লাখ মানুষ জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ৬৪টি জেলা থেকে তার ভক্তরা সমবেদনা জানাতে এসেছিল।
এই ফজলুল কাদের চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, স্টিল মিল, ইস্টার্ন রিফাইনারি, পতেঙ্গা পোর্ট, চট্টগ্রাম নিউমার্কেট, ২৫টি উন্নতমানের বাজার, কয়েক শতাধিক মিল-কারখানা বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এ কথা তার শত্রুও স্বীকার করে। আমি চট্টগ্রামে ৩০ বছর থেকে সব দেখেছি। তার অবদান অনস্বীকার্যভাবে স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় সে হবে অকৃতজ্ঞ মানুষ হিসেবে বিবেচিত।
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
[email protected]



