সর্বনাশা মাদকের বিষ : প্রতিবেশীদের কৌশল এবং আমাদের করণীয়

দেশের যুব সমাজকে রক্ষা করা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এটি এখন আর কোনো ঐচ্ছিক কাজ নয়, বরং অবশ্যকরণীয় কর্তব্য। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছাই আজ শেষ ভরসা।

এ এইচ এম ফারুক
এ এইচ এম ফারুক |নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

বাংলাদেশ বর্তমানে কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে আসা মাদকের এক নীরব আগ্রাসনেরও শিকার। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ আইস এবং ভারত থেকে আসা ফেন্সিডিল, হেরোইনের মতো বিধ্বংসী মাদকগুলো সীমান্তের সহজলভ্যতাকে পুঁজি করে দেশের লাখ লাখ যুবককে আসক্ত করছে। এই আগ্রাসন মূলত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর এক কৌশলগত প্রচেষ্টা—যা মাদক চক্রের বিপুল অর্থ আর কখনো কখনো সশস্ত্র পৃষ্ঠপোষকতা (যেমন : নাফ নদী ও পানিপথে) ব্যবহার করে দেশের যুব সমাজকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এই মাদকগুলো সেবনকারীর মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রে স্থায়ী ক্ষতি করে সাইকোসিস (পাগলামি) সৃষ্টি করে, হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা নষ্ট করে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়, এবং একই সিরিঞ্জ ব্যবহারে এইচআইভি/এইডস ও হেপাটাইটিস-সি ছড়িয়ে দিয়ে জনস্বাস্থ্য সঙ্কট তৈরি করছে। এই বহুমাত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ এখন কেবল ব্যক্তিগত বা সামাজিক সমস্যা নয়; এই মাফিয়া চক্রগুলো তাদের অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে দেশের কোটি কোটি টাকা ডলার হয়ে পাচার করে দিচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে। যেখানে এই চক্রগুলো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেখানে সরকারের কঠোর আইন প্রয়োগের উদ্যোগটিও ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’-এর জালে আবদ্ধ হচ্ছে। মূল হোতা বা অর্থদাতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে কেবল বাহকদের দমন করায় এই আগ্রাসন থামানো যাচ্ছে না—যা জাতীয় নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা এবং অর্থনীতির ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করে মাদকাসক্তিকে এখন দেশের জাতীয় নিরাপত্তা সঙ্কট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ থেকে দেড় কোটি পর্যন্ত হতে পারে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই হলো ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ ও যুবক। উদ্বেগজনকভাবে, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে প্রায় দু’ লাখ ৮৫ হাজার নারী এবং দু’ লাখ ৫৫ হাজার শিশু-কিশোরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপগুলো আপাতদৃষ্টিতে কঠোর আইন ও বড় আকারের অভিযানের মাধ্যমে ‘বজ্র আঁটুনি’ দেখালেও, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ‘গডফাদার’ এবং তাদের অবৈধ অর্থায়নকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং সীমান্তের মূল সরবরাহ চেইন অক্ষত থাকা এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ‘ফস্কা গেরো’ হয়ে আছে, যার ফলস্বরূপ মাদক সাম্রাজ্য নির্বিঘ্নে টিকে থাকছে।

এই প্রবন্ধে আমরা দেখব কিভাবে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তপথ ব্যবহার করে এই বিষ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে এবং এর পেছনে কারা রয়েছে।

দেড় দশকে মাদক উদ্ধারের এক ‘অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ’ চিত্র :

মাদকের অন্যতম রুট কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চল। সেখানে নিয়োজিত আছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) টেকনাফ ব্যাটালিয়ন। এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমানের সাথে। তিনি জানান– ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সর্বমোট তিন কোটি ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ২১৭ পিস ইয়াবা ট্যাবেলট এবং এক শ’ ৪৯ দশমিক ৯৩৩৮ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস জব্দ করা হয়েছে। যার সিজার মূল্য মোট ১৮২৬ কোটি ৫২ রাখ ৫৫ হাজার ১০০ টাকা। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে দু’ হাজার ৭৫৫টি এবং আসামি–এক হাজার ৯৭৫ জন।

এই চিত্র সমন্বিত ভাবে আরো ভয়াবহ। সংশ্লিষ্ঠসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর অদ্যবধি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনী) এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) সমন্বিত অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়েছে, যা মাদকের ভয়াবহ ও অবিচ্ছিন্ন সরবরাহকেই নির্দেশ করে। কেবল ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্তই ২২ কোটি ৩০ লাখের বেশি ইয়াবা পিস এবং ৬৫ লাখের বেশি ফেন্সিডিল বোতল উদ্ধার হয়েছে। এরপর ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইয়াবা উদ্ধারের সংখ্যা আরো বেড়েছে, যা আনুমানিক ৩০ কোটি পিসের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই বিপুল পরিমাণ উদ্ধারের পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে প্রায় ১০ লাখের বেশি আসামির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে এই বিশাল সংখ্যক উদ্ধারের পরও মাদকের প্রবাহ বন্ধ না হওয়া এবং ২০২০ সালের পর ক্রিস্টাল মেথ (আইস)-এর মতো নতুন মাদকের অনুপ্রবেশ প্রমাণ করে যে, কঠোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে মাদকের সরবরাহ রুটগুলো এখনো প্রায় অক্ষত রয়েছে, যা মাদক চক্রের আর্থিক ক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের শক্তিকে ইঙ্গিত করে। (সূত্র : ডিএনসি, বিজিবি, র‌্যাব’র সমন্বিত পরিসংখ্যান এবং জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন)

ইয়াবা-আইস-এর ‘মৃত্যুমিছিল’ ও আরাকান-কক্সবাজার রুট :

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য (আরাকান) এখন বাংলাদেশের ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস-এর আগ্রাসনের প্রধান উৎসস্থল হিসেবে পরিচিত। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’-এর প্রভাব বলয়ের মধ্যে পড়ে।

ইয়াবা ও আইস তৈরির উৎস : মিয়ানমারের শান এবং রাখাইন রাজ্যের ভেতরে অবৈধ কারখানাগুলোতে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস তৈরি হয়। এই কারখানাগুলো প্রায়শই জাতিগত মিলিশিয়া বা শক্তিশালী অপরাধী চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

আরাকান করিডোর : তৈরি হওয়ার পর ইয়াবা ও আইস প্রথমে সড়ক বা পানিপথে রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলে আসে। সেখান থেকে নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের পানিপথ ব্যবহার করে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে প্রবেশ করানো হয়।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যবহার : সীমান্তে বসবাসকারী এবং শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে এই চোরাচালান চক্রগুলো অর্থ ও লোভ দেখিয়ে ‘ক্যারিয়ার’ বা বাহক হিসেবে ব্যবহার করে। ইয়াবা ও আইসের চালান মাছ ধরার ট্রলার, স্পিডবোটের গোপন কামরা বা এমনকি হেঁটে দুর্গম সীমান্ত পেরিয়ে দেশে আসে।

ব্যাপকতা : মিয়ানমার থেকে আসা এই ইয়াবার চালানগুলো আকারে এতটাই বিশাল যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সত্ত্বেও এর সরবরাহ বন্ধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইয়াবার স্রোত দেশের যুব সমাজকে সবচেয়ে দ্রুত ও ভয়াবহভাবে ধ্বংস করছে।

ভারতের সীমান্তে ফেন্সিডিল ও হেরোইনের স্থির প্রবাহ :

মিয়ানমারের ইয়াবার পাশাপাশি ভারতের দীর্ঘ স্থল সীমান্ত বাংলাদেশের মাদক বাজারের জন্য আরেকটি প্রধান রুট। এই পথ ব্যবহার করে প্রধানত ফেন্সিডিল, হেরোইন এবং কিছু ইনজেকটেবল মাদক আসে।

ফেন্সিডিলের রুট : কোডেইন-ভিত্তিক কফ সিরাপ ফেন্সিডিলের প্রধান প্রবাহ আসে ভারতের সীমান্ত-সংলগ্ন রাজ্যগুলো থেকে। যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থল সীমান্তগুলো দিয়ে ফেন্সিডিলের চালান অবৈধভাবে প্রবেশ করে। যদিও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে কঠোরতা বাড়িয়েছে, তবুও চোরাকারবারীরা কাঁটাতারের নিচ দিয়ে গর্ত করে বা কৃষিপণ্যের আড়ালে এই মাদক চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে।

হেরোইন ও ওপিওড : ভারতের ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (আফগানিস্তান) থেকে আসা হেরোইনও সীমান্ত পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই হেরোইন বা ব্রাউন সুগার আসক্তদের মধ্যে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

অন্যান্য ফার্মাসিউটিক্যালস : ব্যথানাশক ওষুধ বা অন্যান্য ইনজেকটেবল ড্রাগস (যেমন বুপ্রেনরফিন) ভারতে বৈধভাবে তৈরি হলেও, সেগুলো অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে আসে এবং আসক্তদের মধ্যে ইনজেকশনের মাধ্যমে সংক্রামক রোগ বিস্তারে ভূমিকা রাখে।

রাজনৈতিক আঁতাত ও সাম্রাজ্যের বিস্তার; আন্তঃআঞ্চলিক চক্রের ভূমিকা :

মাদক চোরাচালান কেবল সাধারণ অপরাধী বা বাহকের কাজ নয়; এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সুসংগঠিত একটি চক্রের আর্থিক বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতা।

রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা : কক্সবাজারের মতো সীমান্ত অঞ্চলে সাবেক জনপ্রতিনিধি বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালানীদের ‘ইয়াবা সম্রাট’ বা ‘গডফাদার’ হিসেবে কাজ করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সরকারি তালিকা এবং গণমাধ্যমে এই ধরনের ব্যক্তিদের নামও প্রকাশিত হয়েছে। তাদের ক্ষমতা ও পারিবারিক প্রভাব ব্যবহার করে তারা মাদক নেটওয়ার্ককে আইনি সুরক্ষা দেয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমকে দুর্বল করার চেষ্টা করে।

আন্তঃআঞ্চলিক সংযোগ : গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রভাবশালী মাদক চক্রগুলো তাদের কার্যক্রম বিস্তারের জন্য নতুন নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি করছে। যেমন, ইয়াবা সম্রাট হিসেবে পরিচিত সাবেক একজন এমপির পরিবারের একজন নিকটাত্মীয়, যিনি আবার বিএনপির একজন সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীরও আত্মীয় পরিচয় দেন, তার মাধ্যমে এই ব্যবসা রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ির মতো পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। একজন খাগড়াছড়ির বাসিন্দা, যিনি একসময় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তিনি সেই রাজনৈতিক আঁতাতের সহায়তায় ঢাকায় কাঠ ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস কারবারের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতা নিয়ে সেখানেও মাদকের বিস্তার ঘটিয়েছেন এবং বর্তমানে ঢাকায় একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাড়ি, গাড়ি ও বিপুল সম্পত্তির মালিক। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, মাদক চক্রগুলো আঞ্চলিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সহজেই তাদের নেটওয়ার্ককে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করছে।

মাদক কারবার; সীমান্তে উত্তেজনা ও সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি :

মাদকের এই অবৈধ বাণিজ্য কেবল দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না, এটি সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। মাদক চোরাচালানকে ঘিরে প্রায়শই সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হয়, বিশেষত যখন মাদক কারবারীরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সমর্থন পায়।

সীমান্তে সশস্ত্র সঙ্ঘাত : মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্য থেকে ইয়াবার চালানগুলো প্রায়শই সশস্ত্র অস্ত্রধারী দল দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (যেমন বিজিবি, র‌্যাব বা কোস্টগার্ড) যখন এই চালানগুলো ধরতে যায়, তখন উভয় পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ধরনের ক্রস-বর্ডার ফায়ারিং আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে এবং দু’ দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

সার্বভৌমত্বের চ্যালেঞ্জ : মাদক কারবারীরা প্রায়শই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের পানিসীমা বা স্থল সীমান্ত ব্যবহার করে। যখন কোনো বিদেশী মাদক চক্র বা তাদের সহায়তাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক দেশের অভ্যন্তরে তাদের কার্যক্রম চালায়, তখন তা রাষ্ট্রের নিজ ভূখণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। মাদক কারবারীদের বিশাল আর্থিক ক্ষমতা এবং অস্ত্রের ব্যবহার রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দেয়, যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে পরোক্ষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

কূটনৈতিক জটিলতা : মাদক চোরাচালান নিয়ে যখন দু’ দেশের মধ্যে দোষারোপের পালা চলে, তখন তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কেও জটিলতা সৃষ্টি করে। একটি রাষ্ট্র মাদকের প্রবাহ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে, অন্য রাষ্ট্র সেটিকে জাতীয় নিরাপত্তার দুর্বলতা হিসেবে দেখতে পারে।

উত্তরণের পথ ও নিরাপত্তার জন্য করণীয় :

মাদক কারবারের বহুমাত্রিক হুমকি ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে মাদকের অনুপ্রবেশ যখন দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করছে, তখন কেবল অভিযান চালিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও বহুস্তরীয় জাতীয় পরিকল্পনা, যা সাপ্লাই চেইন বন্ধ করা, চাহিদা হ্রাস করা এবং আসক্তদের পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেবে।

সরবরাহ চেইন ছিন্ন করা ও আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া :

প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মাদকের প্রধান সরবরাহ পথ সম্পূর্ণ ছিন্ন করা। এর জন্য মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তে নজরদারি ও প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করতে হবে। তবে কেবল বাহক বা খুচরা বিক্রেতা ধরে সমস্যার সমাধান হবে না। মূল ফোকাস দিতে হবে ‘ইয়াবা-আইস গডফাদার’ এবং তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের ওপর। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে যারা মাদকের ট্রানজিট রুট নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর, দ্রুত ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। সাবেক জনপ্রতিনিধি, তার পরিবারের সদস্যরা এবং তাদের রাজনৈতিক আঁতাতের মাধ্যমে যে বিশাল সম্পত্তি (যেমন খাগড়াছড়ির বাসিন্দা একজন মোটরসাইকেল চালক, পরবর্তী সময়ে কাঠ ব্যবসার আড়ালে ঢাকায় গড়ে তোলা বিপুল সম্পত্তি) তৈরি হয়েছে, সেগুলোর অর্থনৈতিক উৎস অনুসন্ধান করে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এই কালো টাকা জব্দ করা গেলে মাদক সাম্রাজ্যের মূল মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীনতা দেয়া অপরিহার্য।

চাহিদা হ্রাস ও পুনর্বাসন :

দ্বিতীয়ত, মাদকের চাহিদা হ্রাস করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল এবং পাড়ায় পাড়ায় ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে মাদকের ভয়াবহ পরিণতি অন্তর্ভুক্ত করা এবং যুবকদের খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করা জরুরি। তৃতীয়ত, আসক্তদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। মাদকাসক্তিকে অপরাধের পরিবর্তে একটি মানসিক রোগ হিসেবে দেখে, তাদের সমাজে ফিরিয়ে আনার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শেষ ভরসা :

মিয়ানমারের রাখাইন রুট হয়ে আসা ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস-এর আগ্রাসন এবং ভারতের সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল ও হেরোইনের প্রবাহ– এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মাদকই আজ বাংলাদেশের যুব সমাজকে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, এই সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য স্থানীয় রাজনীতি এবং প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ, যা মাদক চক্রকে অজেয় করে তুলেছে। যেখানে কক্সবাজারের একজন সাবেক এমপির পরিবার এবং তাদের আত্মীয়তার সূত্র ধরে খাগড়াছড়ির মতো অঞ্চলে মাদক কারবারীরা কাঠ ব্যবসার আড়ালে সাম্রাজ্য বিস্তার করে, সেখানে এটি স্পষ্ট যে কেবল অভিযান দিয়ে এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়। ক্রিস্টাল মেথ আইস ও ইয়াবার মতো বিষের আগমন বন্ধ করতে হলে, সরকারকে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হবে এবং মাদকের অর্থায়নকারী গডফাদারদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। দেশের যুব সমাজকে রক্ষা করা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এটি এখন আর কোনো ঐচ্ছিক কাজ নয়, বরং অবশ্যকরণীয় কর্তব্য। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছাই আজ শেষ ভরসা।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।